যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য সচিব রবার্ট এফ. কেনেডি জুনিয়রের অটিজম (Autism)-এর কারণ আবিষ্কারের সময়সীমা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, কয়েক মাসের মধ্যে অটিজমের মূল কারণ খুঁজে বের করার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন, তা বাস্তবসম্মত নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অটিজম কোনো একক কারণে সৃষ্ট রোগ নয়, বরং এটি বহুবিধ জটিলতার ফল। জিনগত এবং স্নায়ু-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। গবেষণা বলছে, ভ্রূণের মস্তিষ্কের বিকাশের সময় থেকেই এর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিস মাইন্ড ইনস্টিটিউটের দীর্ঘদিনের অটিজম গবেষক ডেভিড আমারাল বলেন, “অটিজমের কারণগুলো, যা একাধিক হতে পারে, তার সবই ভ্রূণের মস্তিষ্কের বিকাশে প্রভাব ফেলে।” যদিও শিশুদের বয়স ২-৩ বছর না হওয়া পর্যন্ত অটিজমের লক্ষণগুলো বোঝা যায় না, তবে এর জৈবিক পরিবর্তনগুলো অনেক আগেই ঘটে যায়।
সম্প্রতি, স্বাস্থ্য সচিব কেনেডি ঘোষণা করেছেন যে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ (NIH) একটি নতুন ডাটাবেস তৈরি করবে। এই ডাটাবেসে মেডিকেইড ও মেডিকেয়ারের তথ্য এবং ইলেক্ট্রনিক স্বাস্থ্য রেকর্ড একত্রিত করা হবে, যার উদ্দেশ্য হলো “অটিজম এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের মূল কারণগুলো” খুঁজে বের করা।
কেনেডি অটিজমের ক্রমবর্ধমান হারকে একটি “প্রতিরোধযোগ্য রোগের” প্রাদুর্ভাব হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং এর কারণ হিসেবে পরিবেশগত প্রভাবকে দায়ী করেছেন। তিনি সেপ্টেম্বরের মধ্যে কিছু উত্তর পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অটিজম একটি জটিল বিষয়, যা জিনগত ও পরিবেশগত—উভয় ধরনের কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত। তারা মনে করেন, কেনেডির প্রস্তাবিত ডাটাবেসে জিনগত তথ্য অন্তর্ভুক্ত না থাকায় অটিজমের কারণ অনুসন্ধান করা কঠিন হবে।
অটিজম আসলে কোনো রোগ নয়, বরং এটি একটি জটিল স্নায়ু-বিকাশগত সমস্যা, যা ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার’ (Autism Spectrum Disorder) নামে পরিচিত। এই ডিসঅর্ডারের কারণে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আচরণগত এবং সামাজিক সমস্যা দেখা যায়।
কারো কারো ক্ষেত্রে এটি গুরুতর হতে পারে, যেখানে কথা বলতে বা বুদ্ধিগত সমস্যা হতে পারে। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এটি মৃদু হতে পারে, যেমন সামাজিক এবং আবেগগত ক্ষেত্রে সমস্যা।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অটিজম বিশেষজ্ঞ হেলেন টেগার-ফ্লুসবার্গ বলেন, বর্তমানে হালকা ধরনের অটিজমের সংখ্যা বাড়ছে, কারণ চিকিৎসকরা ধীরে ধীরে এর লক্ষণগুলো বুঝতে পারছেন। আগে এর সংজ্ঞা এবং নির্ণয় পদ্ধতি ভিন্ন ছিল।
অটিজম গবেষণায় জিনগত কারণগুলো গুরুত্বপূর্ণ। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু জিনগত পরিবর্তন এর জন্য দায়ী। এগুলোর মধ্যে কিছু বিরল জিনগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা বাবা-মা থেকে সন্তানের মধ্যে আসতে পারে।
এমনকি বাবা-মার মধ্যে অটিজমের কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে। আমারাল ব্যাখ্যা করেন, মস্তিষ্কের দ্রুত বিভাজনের সময় কোষগুলোতে ত্রুটি দেখা দিতে পারে, যা মস্তিষ্কের কোনো একটি অংশে বা কোষে মিউটেশন ঘটাতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মস্তিষ্কের কার্যকারিতার ধরনগুলো সনাক্ত করতে পারলে অটিজম নির্ণয় সহজ হতে পারে। তবে, এই ধরনের পরিবর্তনগুলো মস্তিষ্কের গঠন বা স্নায়ু সার্কিটের পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলো বুঝতে মৃত্যুর পর উপলব্ধ মস্তিষ্কের টিস্যু পরীক্ষা করতে হয়।
অটিজম ব্রেইননেট নামের একটি গবেষণা সংস্থা, যা এই ধরনের মস্তিষ্ক সংগ্রহ করে গবেষণা চালায়। এই সংস্থার সংগ্রহে অটিজম আক্রান্ত এবং অ-আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায় ৪০০টির বেশি মস্তিষ্ক রয়েছে।
পরিবেশগত কারণগুলোর মধ্যে পিতার বয়স, গর্ভাবস্থায় মায়ের স্বাস্থ্য সমস্যা (যেমন ডায়াবেটিস), গর্ভাবস্থায় কিছু ওষুধের ব্যবহার এবং অপরিণত জন্ম অন্যতম। টেগার-ফ্লুসবার্গ জোর দিয়ে বলেন, হামের টিকা এবং অটিজমের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, যা বহু আগে থেকেই প্রমাণিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ডেনমার্ক ও নরওয়ের মতো দেশগুলোর মতো নয়, যেখানে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রয়েছে। এই দেশগুলোতে অটিজমের নির্ণয়ের হার বাড়লেও পরিবেশগত কোনো নির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায়নি।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস