বিমানবন্দরের কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে কর্মকর্তাদের ‘ভুল’ সিদ্ধান্তের ফল?

যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দরে ডেটা বিভ্রাটের কারণে বিমান চলাচলে বিঘ্ন ঘটার পর দেশটির বিমান চলাচল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FAA) -এর অভ্যন্তরীণ একটি প্রতিবেদনে এই ডেটা বিভ্রাটের ঝুঁকিকে কম করে দেখানোর অভিযোগ উঠেছে, যা এখন তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

জানা গেছে, নিউইয়র্কের কাছাকাছি অবস্থিত নিউয়ার্ক লিবার্টি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের আকাশ পথের নিয়ন্ত্রকদের গত বছর ফিলাডেলফিয়ায় সরিয়ে নেওয়ার আগে FAA বিশেষজ্ঞরা একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনেData Outage-এর মারাত্মক ঝুঁকিকে “খুবই কম” হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এমন ঘটনার সম্ভাবনা ছিল ১১ মিলিয়নে ১ বার। কিন্তু বাস্তবে, নতুন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকেই বেশ কয়েকবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগের ঘটনা ঘটেছে।

গত কয়েক সপ্তাহে ডেটা বিভ্রাটের কারণে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা প্লেনের অবস্থান জানতে সমস্যায় পড়েছেন। একবার প্রায় ৯০ সেকেন্ডের জন্য রাডার এবং রেডিও পরিষেবা বন্ধ ছিল। এর ফলে অনেক ফ্লাইট বিলম্বিত হয়েছে এবং বাতিলও করতে হয়েছে, যার কারণে বিমানবন্দরের কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব পড়েছে।

২০২২ সালের FAA-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সম্ভাব্য ডেটা বিভ্রাটের কারণে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে, তবে এর ঘটনার সম্ভাবনা খুবই কম। সেই কারণে সামগ্রিক ঝুঁকিকে “মাঝারি” হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের মূল্যায়ন FAA-এর নিরাপত্তা বিশ্লেষণ নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

পরিবহন বিভাগের সাবেক ইনস্পেক্টর জেনারেল মেরি শিয়াভো এই প্রতিবেদনের সমালোচনা করে বলেছেন, ডেটা বিভ্রাটের সম্ভাবনা কম দেখানোর এই সিদ্ধান্ত “ভয়াবহ এবং উদ্বেগজনক”। তার মতে, বিভিন্ন ডেটা সিস্টেম একত্র করে একটি “ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কাঠামো” তৈরি করা হয়েছিল, যা অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণ হয়েছে। যদিও প্রতিবেদনে রাডার ডেটা ট্রান্সমিশনে ত্রুটিকে “গুরুতর বিপদ” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল, তবে সম্ভবত ঘটনার সম্ভাবনা কম বলেই এটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

FAA মুখপাত্র অবশ্য নিরাপত্তা পর্যালোচনা নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি জানিয়েছেন, নতুন সরঞ্জাম, কার্যক্রম এবং পদ্ধতি চালু করার সময় FAA তাদের স্ট্যান্ডার্ড নিরাপত্তা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ করে।

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের ইউনিয়ন, ন্যাশন্যাল এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার্স অ্যাসোসিয়েশন (NATCA) -এর কয়েকজন সদস্যও এই নিরাপত্তা পর্যালোচনা প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

FAA যখন নিউয়ার্কের বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণকারীদের সরিয়ে ফিলাডেলফিয়ায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে, তখনই এই “নিরাপত্তা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা” বিষয়ক প্রতিবেদনগুলি তৈরি করা হয়েছিল। কয়েক দশক ধরে, তারা লং আইল্যান্ডে অবস্থিত একটি কেন্দ্রে জন এফ কেনেডি এবং লাগোয়ার্ডিয়া বিমানবন্দরের কাছাকাছি থাকা অন্যান্য কন্ট্রোলারদের সাথে কাজ করতেন। কিন্তু কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য FAA প্রায় দুই ডজন কন্ট্রোলারকে ফিলাডেলফিয়ার নতুন কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়, যা জুলাই, ২০২৪ এ সম্পন্ন হয়।

২০২২ সালের একটি গবেষণায় FAA-এর ১১ জন বিশেষজ্ঞ এবং ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের একটি দল এই স্থানান্তরের প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জগুলো মূল্যায়ন করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিউয়ার্কগামী বিমানের রাডার ডেটা লং আইল্যান্ড থেকে ফিলাডেলফিয়ার নতুন কেন্দ্রে আটটি বাণিজ্যিক টেলিকমিউনিকেশন লাইনের মাধ্যমে প্রেরণ করা হবে। তবে, এই আটটি লাইন সক্রিয় আছে কিনা, সে বিষয়ে FAA-এর পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

২০২২ সালের ওই প্রতিবেদনে লং আইল্যান্ড ও ফিলাডেলফিয়ার মধ্যে “টেলিকমিউনিকেশন লাইনের ক্ষতি” এবং এর ফলে “স্বয়ংক্রিয় পরিষেবা এবং নজরদারির সহায়তার অভাব”-কে একটি সম্ভাব্য বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন ঘটনার ফলে কন্ট্রোলারদের বিমান পর্যবেক্ষণে সমস্যা হবে এবং বিমান নিরাপদে পরিচালনা করতে অসুবিধা হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিমানবন্দরে “পূর্ণাঙ্গ পরিষেবা বিভ্রাটের” আগের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের মে মাস থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৩৫টি প্রধান বিমানবন্দরে এমন ঘটনা ঘটেছে মাত্র একবার। ফলে, লং আইল্যান্ড থেকে ফিলাডেলফিয়া ডেটা লাইনে বিভ্রাটের সম্ভাবনা ১১ মিলিয়নে ১ বার—যা খুবই কম।

FAA-এর পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, নিউয়ার্কে সমস্যা সমাধানে লং আইল্যান্ড ও ফিলাডেলফিয়ার মধ্যে তিনটি নতুন উচ্চ-গতির টেলিকমিউনিকেশন সংযোগ স্থাপন করা হবে। এর ফলে ডেটার গতি, নির্ভরযোগ্যতা এবং নিরাপত্তা বাড়বে। এছাড়াও, তামার তারের পরিবর্তে ফাইবার অপটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, যা আরও বেশি ব্যান্ডউইথ এবং গতি সরবরাহ করবে।

২০২৪ সালের নিরাপত্তা প্রতিবেদনে লং আইল্যান্ডে থাকা কন্ট্রোলারদের সাথে ফিলাডেলফিয়ার নিউয়ার্ক কন্ট্রোলারদের কাজের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এতে “পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব” এবং “কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি”-র মতো সম্ভাব্য কিছু ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কন্ট্রোলারদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে FAA-এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

তথ্য সূত্র: CNN

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *