আগুনে পাহাড়: প্রকৃতির বিস্ময়কর ১৫টি তথ্য যা আপনার জানা দরকার
আগ্নেয়গিরি শুনলেই যেন এক ভীতিকর দৃশ্যের অবতারণা হয়, তাই না? পাহাড় থেকে গলিত লাভা নির্গত হওয়া, আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী—এসব দৃশ্য কল্পনা করলেই গা ছমছম করে ওঠে। তবে, ভয়ংকর রূপের আড়ালে আগ্নেয়গিরি প্রকৃতির এক দারুণ বিস্ময়। আসুন, আজ আমরা আগ্নেয়গিরি সম্পর্কে ১৫টি মজাদার তথ্য জেনে নিই যা হয়তো আগে জানা ছিল না।
১. আগ্নেয়গিরির গঠন:
আগ্নেয়গিরির আকার কিন্তু সব সময় এক রকম হয় না। এদের গঠন লাভা কেমন, সেটির ওপর নির্ভর করে। যেমন— জাপানের ফুজি পর্বতের মতো উঁচু, শঙ্কু আকৃতির আগ্নেয়গিরিকে ‘কম্পোজিট’ বা ‘স্ট্র্যাটো-আগ্নেয়গিরি’ বলা হয়। এই ধরনের আগ্নেয়গিরি থেকে ঘন লাভা নির্গত হয়, যা দ্রুত জমাট বাঁধে এবং খাড়া ঢাল তৈরি করে।
অন্যদিকে, ‘শিল্ড’ আগ্নেয়গিরিগুলো অপেক্ষাকৃত চ্যাপ্টা হয়। এদের লাভা তুলনামূলক তরল হওয়ায় অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে এবং ধীরে ধীরে জমাট বাঁধে, ফলে ঢালগুলো মৃদু হয়।
২. দ্রুত বাড়তে পারে:
আগ্নেয়গিরি খুব দ্রুত বাড়তে পারে, যা শুনলে হয়তো অবাক হবেন। ১৯৪৩ সালে মেক্সিকোর এক কৃষক, দিওনিসিও পুলিডোর ঘটনাটি ভাবুন। তিনি একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, তার উঠোনে একটি আগ্নেয়গিরি! এটির নাম ছিল পারিকুটিন।
প্রথম দিনেই এটি প্রায় ৫০ মিটার (১৬৪ ফুট) উঁচু হয়ে গিয়েছিল এবং এক সপ্তাহের মধ্যে এর উচ্চতা হয় ১৫০ মিটার (৪৯২ ফুট)। নয় বছর ধরে সক্রিয় থাকার পর, ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এটি শেষবার অগ্নুৎপাত ঘটায়। বর্তমানে এটি সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে।
৩. পানির নিচেও:
পৃথিবীর প্রায় ৭৫ শতাংশ আগ্নেয়গিরিই সমুদ্রের নিচে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি ‘প্যাসিফিক রিং অফ ফায়ার’ নামে পরিচিত, যা ঘোড়ার খুরের মতো দেখতে। এখানে পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ ভূমিকম্পও হয়ে থাকে।
পানির নিচের এই আগ্নেয়গিরিগুলো সমুদ্রের তলদেশের ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটায়। মাঝে মাঝে এগুলো এতটাই বড় হয়ে ওঠে যে, সমুদ্রপৃষ্ঠ ভেদ করে নতুন দ্বীপের সৃষ্টি করে।
৪. সক্রিয়তা:
আগ্নেয়গিরি সক্রিয়, সুপ্ত অথবা বিলুপ্ত হতে পারে। যেগুলোর অগ্নুৎপাত গত ১০,০০০ বছরের মধ্যে হয়েছে, তাদের সক্রিয় ধরা হয়। এছাড়া, বর্তমানে অগ্নুৎপাত হচ্ছে বা সামান্য ভূমিকম্পের মতো লক্ষণ দেখা গেলেও সেগুলোকে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি হিসেবে ধরা হয়।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ভবিষ্যতে সক্রিয় হতে পারে। আর যেগুলোর ১০,০০০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে কোনো সক্রিয়তা নেই, সেগুলোকে বিলুপ্ত হিসেবে ধরা হয়। পৃথিবীতে প্রায় ১,৯০০টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে।
৫. অগ্নুৎপাতের সংখ্যা:
প্রতি বছর প্রায় ৬০টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরিতে অগ্নুৎপাত হয়। ইন্দোনেশিয়া আগ্নেয়গিরির দিক থেকে বেশ সক্রিয়। ১৯৬০ সাল থেকে এ পর্যন্ত এখানে ৫৫টি আগ্নেয়গিরি সক্রিয় ছিল। এর পরেই রয়েছে জাপান, যেখানে ৪০টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের স্থান তৃতীয়, যেখানে ৩৯টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি দেখা যায়।
৬. ইতিহাসের সবচেয়ে জোরালো শব্দ:
১৮৮৩ সালে ক্রাকাতোয়া আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে জোরালো শব্দ। এর শব্দ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, তা প্রায় ৩১০ ডেসিবেল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এই শব্দ ২,০৯২ কিলোমিটার (১,৩০০ মাইল) দূরের বঙ্গোপসাগরেও শোনা গিয়েছিল। এমনকি, ৪,৮২৮ কিলোমিটার (৩,০০০ মাইল) দূরের ভারত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতেও বন্দুকের গুলির মতো শব্দ অনুভূত হয়েছিল।
৭. লাভা ও ম্যাগমা:
লাভা এবং ম্যাগমা—এই দুটি আসলে একই জিনিস, শুধু অবস্থানের ভিন্নতা রয়েছে। ভূ-অভ্যন্তরের গলিত পাথরকে ম্যাগমা বলে। এটি যখন ভূপৃষ্ঠের উপরে আসে, তখন তাকে লাভা বলা হয়।
৮. বরফের আগ্নেয়গিরি:
পৃথিবীর বাইরেও, যেমন—প্লুটো, শনির উপগ্রহগুলিতেও ‘ক্রায়োভলকানোস’ বা বরফের আগ্নেয়গিরি দেখা যায়। এগুলো গলিত পাথরের বদলে পানি, হাইড্রোকার্বন এবং অ্যামোনিয়ার মিশ্রণ নির্গত করে।
৯. আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি:
আশ্চর্যের বিষয় হলো, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে নির্গত হওয়া ছাই বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে। ছাইয়ের কণাগুলো ঘর্ষণের ফলেStatic electricity তৈরি করে এবং এর থেকেই বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
১০. ভূমির সৃষ্টি:
আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভা জমাট বেঁধে নতুন ভূমি তৈরি করে। পৃথিবীর প্রায় ৮০ শতাংশ ভূমি আগ্নেয়গিরির মাধ্যমেই গঠিত হয়েছে। এমনকি, হাওয়াই, ইস্টার আইল্যান্ড, গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ এবং জেজু দ্বীপের মতো অনেক দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে আগ্নেয়গিরির কারণে।
১১. মাউন্ট এভারেস্টের চেয়েও উঁচু:
হাওয়াই দ্বীপের একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, মাউনা কেয়া-এর উচ্চতা এভারেস্টের চেয়ে বেশি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাপলে এভারেস্টের উচ্চতা ৮,৮৪৯ মিটার (২৯,০৩২ ফুট), কিন্তু মাউনা কেয়ার উচ্চতা ১০,২০৫ মিটার (৩৩,৪৮১ ফুট)। তবে, এর প্রায় ৬,০০০ মিটার (১৯,৬৮৫ ফুট) সমুদ্রের নিচে থাকায় একে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বত হিসেবে ধরা হয় না।
১২. সৌরজগতের বৃহত্তম আগ্নেয়গিরি:
সৌরজগতের বৃহত্তম আগ্নেয়গিরিটি মঙ্গলে অবস্থিত। এর নাম অলিম্পাস মন্স, যা প্রায় ২১,৮৮৭ মিটার (৭১,৮০৮ ফুট) উঁচু। এটি এভারেস্টের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বড়!
১৩. ম্যাগমার তাপমাত্রা:
অগ্নুৎপাতের সময় ম্যাগমার তাপমাত্রা প্রায় ১,২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২,২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পর্যন্ত হতে পারে। এই উচ্চ তাপমাত্রায় প্লাস্টিক এবং অ্যালুমিনিয়ামের মতো ধাতুও গলে যেতে পারে।
১৪. লাভার রং:
লাভার রং দেখে এর তাপমাত্রা বোঝা যায়। সবচেয়ে উত্তপ্ত লাভা উজ্জ্বল কমলা বা লাল রঙের হয়, যার তাপমাত্রা ১,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (১,৮৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেশি থাকে। কালো বা বাদামি রঙের লাভা তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা, তবে তখনও এর তাপমাত্রা ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৯৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেশি থাকে।
১৫. উর্বর ভূমি:
আগ্নেয়গিরির আশেপাশে মাটি খুব উর্বর হয়। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নির্গত হওয়া ছাই মাটির সঙ্গে মিশে প্রাকৃতিক সারের কাজ করে, যা গাছপালা ও শস্যের জন্য খুবই উপকারী।
আগ্নেয়গিরি নিঃসন্দেহে প্রকৃতির এক বিস্ময়। এদের ধ্বংসাত্মক রূপ থাকলেও, এরা আমাদের পৃথিবীর সৌন্দর্য বাড়াতেও সাহায্য করে। আগ্নেয়গিরি একদিকে যেমন ভয়ানক, তেমনি এরা আমাদের পরিবেশের জন্য অনেক উপকারী উপাদানও তৈরি করে।
তথ্য সূত্র: ট্রাভেল অ্যান্ড লেজার