ফ্যাশনের ভবিষ্যৎ: পোশাকের জন্য খামার?

বাংলাদেশের ফ্যাশন বিশ্বে পরিবর্তনের সুর, ‘ফার্ম টু ক্লোজেট’ ধারণার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বিশ্বজুড়ে পরিবেশ-বান্ধব ফ্যাশনের চাহিদা বাড়ছে, আর এই পরিবর্তনের পথে এক নতুন দিশা দেখাচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার ‘সুক্খাচিতা’ (SukkhaCitta)। পোশাক শিল্পে টেকসই উৎপাদন এবং কারিগর ও কৃষকদের ন্যায্য অধিকারের ধারণা নিয়ে কাজ করা এই ব্র্যান্ডটি বর্তমানে সারা বিশ্বে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে।

তাদের মূলমন্ত্র হল, পোশাক তৈরি হবে প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে, যেখানে কারিগরদের শ্রমের সম্মান থাকবে, পরিবেশের ক্ষতি হবে না।

সুক্খাচিতার প্রতিষ্ঠাতা ডেনিকা রিয়াদিনি-ফ্লেশ, ইন্দোনেশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করছেন। তিনি স্থানীয় কারিগর ও কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেন, তাঁদের ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও চাষাবাদের পদ্ধতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

বাটিকের মতো ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্মে, যা একসময় বিলুপ্তির পথে ছিল, সুক্খাচিতা নতুন প্রাণ দিয়েছে। বাটিক হলো মোম ব্যবহার করে কাপড়ে নকশা করার এক বিশেষ পদ্ধতি।

ডেনিকা ইন্দোনেশিয়ার জাভা, বালি, ফ্লোরেস এবং ওয়েস্ট টিমরের কারিগরদের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি তাঁদের প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেন, যেমন – আসাম ইন্ডিগো নামক এক প্রকারের নীল গাছ, যা কাপড়ে রং করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

এই ইন্ডিগো চাষের ফলে স্থানীয় কৃষকরা যেমন একদিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, তেমনই পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হচ্ছে। সুক্খাচিতা নিশ্চিত করে, পোশাক তৈরির প্রতিটি পর্যায়ে প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার এবং কারিগরদের ন্যায্য পারিশ্রমিক।

ফাস্ট ফ্যাশনের যুগে, যেখানে দ্রুত পোশাক তৈরির প্রবণতা বাড়ে, সেখানে সুক্খাচিতা ‘স্লো ফ্যাশন’-এর ধারণা নিয়ে এসেছে। স্লো ফ্যাশন মানে হলো ধীরে ধীরে, যত্ন সহকারে পোশাক তৈরি করা।

এর ফলে পোশাকের গুণগত মান যেমন বজায় থাকে, তেমনই পরিবেশের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাবও কমে আসে। দ্রুত ফ্যাশন শিল্পের কারণে সৃষ্ট দূষণ এবং শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে সুক্খাচিতা এক শক্তিশালী প্রতিবাদ।

সুক্খাচিতা শুধু একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড নয়, এটি একটি সামাজিক উদ্যোগও বটে। এই ব্র্যান্ডটি কারিগরদের প্রশিক্ষণ দেয়, তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য দেয়, এবং তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করে।

স্থানীয় সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুক্খাচিতার অবদান অনস্বীকার্য। ব্র্যান্ডটি তাঁদের লাভের একটি অংশ গ্রামের মানুষের জন্য ভূমি ক্রয়ের মতো বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ব্যয় করে।

সুক্খাচিতার এই উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে এখন টেকসই ফ্যাশন নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছেন। এর ফলে ভোক্তারা তাঁদের পোশাক সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন এবং পরিবেশ-বান্ধব পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন।

সেলিব্রিটি এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও সুক্খাচিতার পোশাক পরতে শুরু করেছেন, যা ব্র্যান্ডটির জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

সুক্খাচিতা ইন্দোনেশিয়ায় পরিবেশবান্ধব ব্যবসার স্বীকৃতি হিসেবে ‘বি কর্পোরেশন’ সনদও অর্জন করেছে, যা তাদের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার প্রমাণ।

ব্র্যান্ডটি ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি কারুশিল্প বিদ্যালয় স্থাপন করেছে এবং স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। তাদের লক্ষ্য হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে টেকসই চাষাবাদ করা এবং ১০,০০০ জনেরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো।

ডেনিকা রিয়াদিনি-ফ্লেশ মনে করেন, পোশাক শুধু ফ্যাশন নয়, এটি পরিবর্তনের একটি মাধ্যমও হতে পারে। তাঁর এই ধারণা ‘উরিপ ইকু উরূপ’ -এর দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত, যার অর্থ হলো, ‘আমরা আলো জ্বালাই’।

সুক্খাচিতা প্রমাণ করেছে, ফ্যাশন শিল্পে পরিবর্তন আনা সম্ভব, যা একইসঙ্গে পরিবেশের জন্য ভালো এবং সমাজের জন্য উপকারী।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *