বাবা স্মৃতিচিহ্নগুলো ফেলে দিলেন, তারপর…

একটি কঠিন শোকগাথা: বাবার আত্মহত্যার পর স্মৃতির ঝাঁপি হারানোর যন্ত্রণা

জীবন কখনো কখনো অপ্রত্যাশিত মোড় নেয়, যা আমাদের গভীর দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত করে। তেমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনার শিকার হয়েছেন একজন নারী, যিনি তার বাবার আত্মহত্যার পর একদিকে যেমন বাবাকে হারিয়েছেন, তেমনই হারিয়েছেন তার শৈশব ও কৈশোরের অমূল্য স্মৃতিচিহ্নগুলো।

বাবার একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে, বহু বছর ধরে পরম যত্নে রাখা ব্যক্তিগত স্মৃতির ঝাঁপিটি তিনি হারান।

ঘটনাটি ছিল এমন – বাবার কাছে রাখা ছিল তার ব্যক্তিগত ডায়েরি, ছবি এবং চিঠি-সহ আরও অনেক স্মৃতিবিজড়িত জিনিস। কোভিড মহামারীর আগে, মেয়েটির বাবা সেই স্মৃতির ঝাঁপিটি ফেলে দেন।

এরপরই তিনি আত্মহত্যা করেন। একদিকে প্রিয় বাবাকে হারানো এবং অন্যদিকে এতদিনের স্মৃতিগুলো হারানো – এই দুই শোকের ধাক্কা যেন একসঙ্গেই এসেছিলো।

কোভিড পরিস্থিতি আসার কারণে প্রথম ধাক্কাটি অনেকটা চাপা পড়ে যায়, কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর পুরনো সেই শোক আবার ফিরে আসে।

সেই স্মৃতিগুলো হারানোর বেদনা আজও তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। তার মনে হয়, যেন তার জীবনের একটা অংশ হারিয়ে গেছে, যা আর কোনোদিন ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।

বিষয়টি নিয়ে যখন তিনি অন্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তখন অনেকে হয়তো তাকে ‘কিছু জিনিস’-এর বেশি গুরুত্ব দিতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু এই স্মৃতিগুলো তার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন, তা তিনি নিজেও জানেন না।

কীভাবে এই শোক কাটিয়ে উঠবেন, সেই পথও তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। মাঝেমধ্যে তিনি নিজেকেই দোষারোপ করেন, কেন তিনি এত দ্রুত তার বাবার কাছ থেকে নিজের জিনিসগুলো সরিয়ে নেননি।

এই গভীর শোকের সময়ে, একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শোক বিশেষজ্ঞ ম্যান্ডি গসলিং-এর মতে, “এই ধরনের ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। স্মৃতিচিহ্নগুলো আমাদের ভেতরের জগৎ এবং বাইরের জগতের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে।

এগুলো অতীতের স্মৃতি এবং শরীরের অনুভূতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। হারানো স্মৃতিগুলো পুনরায় ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।”

গসলিং আরও বলেন, “যে জিনিসগুলো হারিয়ে গেছে, সেগুলো নিছক ‘জিনিস’ নয়, বরং অতীতের স্মৃতি, যা ব্যক্তির জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বাবার এই কাজের জন্য আপনি অবশ্যই রাগ করতে পারেন।

এতে তার প্রতি আপনার ভালোবাসা কম হবে না।” তিনি আরও যোগ করেন, “যখন একের পর এক আঘাত আসে, তখন তীব্র অনুভূতি তৈরি হয়। অনেক সময় একটি শোক থেকে অন্যটিকে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

এক্ষেত্রে, বাবার মৃত্যু এবং স্মৃতির ঝাঁপি হারানোর শোক – দুটো মিলেই মানসিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। এমনও হতে পারে, স্মৃতির ঝাঁপির শোক প্রকাশ করা বাবার মৃত্যুর শোকের চেয়ে সহজ মনে হচ্ছে।

গভীর শোকের সময়, অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে না পারলে তা আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে যেতে পারে না। তাই, একজন থেরাপিস্ট বা শোক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে, সেই অনুভূতিগুলো ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করা উচিত।

যদি সেই মেয়েটির কাছে ঝাঁপিটি থাকত, তাহলে কি তিনি সেটি দেখতেন? সেটি কি তাকে সাহায্য করত?

নাকি বন্ধুদের কাছ থেকে পুরনো দিনের স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ করে নতুন একটি স্মৃতি-সংগ্রহ তৈরি করা যেত? সম্ভবত, তিনি সেই বাক্সটি খুব বেশি দেখতেন না।

যেহেতু তিনি বাবার কাছে জিনিসগুলো রেখেছিলেন, তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল।

গসলিং-এর পরামর্শ অনুযায়ী, উভয় ক্ষতি থেকে সেরে ওঠা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “এই শোক থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সহজ উপায় নেই, তবে জীবনের সঙ্গে এটিকে একীভূত করার পথ খুঁজে বের করা যেতে পারে।”

স্মৃতির ঝাঁপির বিষয়বস্তু মনে করার জন্য গসলিং কিছু ভিজ্যুয়ালাইজেশন করার পরামর্শ দেন, যা শরীরের অনুভূতিগুলো বুঝতে সাহায্য করবে।

মনে রাখতে হবে, “কিছু জিনিস” ভেবে শোক প্রকাশ না করলে, আপনি মনোকষ্টে আটকে যাবেন। তাই, বাবার প্রতি আপনার ভালোবাসাকে অটুট রেখে, তার কাজের জন্য রাগ করাটাও স্বাভাবিক।

সুস্থ শোক হলো, আমাদের মৃত স্বজনদের মানুষ হিসেবে স্মরণ করা।

যদি আপনি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বা আত্মহত্যার চিন্তা অনুভব করেন, তাহলে দ্রুত সাহায্য নিন। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার জন্য কিছু নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা রয়েছে।

আপনি আপনার এলাকার কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এ ছাড়াও, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হেল্পলাইন এবং কাউন্সেলিং সেন্টারগুলো আপনার জন্য সহায়ক হতে পারে।

নিচে কয়েকটি নির্ভরযোগ্য হেল্পলাইনের নম্বর দেওয়া হলো:

  • কান পেতে রই: ১০৯৮
  • আত্মহত্যা প্রতিরোধ বিষয়ক হেল্পলাইন, লাইভ সাপোর্ট: ০৩৭৭৭১১০০০

মনে রাখবেন, আপনি একা নন। সাহায্য চাইতে দ্বিধা করবেন না।

তথ্য সূত্র: The Guardian

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *