বসন্তের ফ্যাশনে পালকের ঝলক: বিলাসিতা নাকি নৈতিকতার দ্বন্দ্ব?
ফ্যাশন দুনিয়ায় প্রায়ই নতুন নতুন ধারা আসে, আর পুরনো অনেক কিছুই ফিরে আসে নতুন রূপে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ফ্যাশন উইকগুলোতে (যেমন: নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস) পালকের ব্যবহার আবারও বেশ চোখে পড়ছে।
ব্র্যান্ডন ম্যাক্সওয়েলের ডিজাইন করা একটি বেজ রঙের কোটের সামনে ছিল কালো পালকের ছড়াছড়ি, অথবা আল্টুজারার তৈরি পোশাক, যা পরলে মনে হচ্ছিল যেন পালক দিয়ে মোড়া হয়েছে, তবে তা ছিল দৃষ্টিনন্দন। প্রবাল গুরুংয়ের ডিজাইন করা গাউনে ছিল সাদা পালকের মেঘের মতো আস্তরণ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই পালকের ফ্যাশন কি নিছক একটি রুচি, নাকি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস এবং নৈতিকতার প্রশ্ন?
পালকের ব্যবহার ফ্যাশনে নতুন নয়। প্রাচীন মিশরে উটপাখির পালক দিয়ে তৈরি হতো পাখা, যা Hieroglyphics-এও দেখা যায়। ব্যাবিলন ও আসিরীয় শিল্পকর্মে দেবতাদের শরীরে অথবা রাজাদের মুকুটে পালকের ব্যবহার ছিল।
পঞ্চদশ শতকে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে, পালক ফ্যাশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। হাঁস, মুরগি এবং সাদা বকের পালক, যা চক ও সালফার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হতো, তা টুপি ও পাখার সাথে যুক্ত করা হতো।
আঠারো শতকে, ফরাসি রানি মেরি আঁতোয়ানেত-এর সময়ে বিশাল আকারের পালকের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়। সাধারণত উটপাখির পালক ব্যবহার করা হতো, যা ছিল সবচেয়ে মূল্যবান।
উনিশ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার ও বাণিজ্যের প্রসারের সাথে সাথে পালকের চাহিদা বাড়ে। নিউ গিনির মতো দ্বীপ থেকে পাখির চামড়া ও পালক সংগ্রহ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় বিক্রি করা হতো। এই সময় পালক বিলাসিতা ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৯১২ সালে টাইটানিক যখন ডুবে যায়, তখন জাহাজে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্রের মধ্যে উটপাখির পালক ছিল অন্যতম। সেগুলোর বীমা করা হয়েছিল প্রায় ২.৩ মিলিয়ন ডলারে (বর্তমান মূল্যে)।
তবে এই ফ্যাশনের বিরুদ্ধেও ছিল প্রতিবাদ। অনেকে পাখির ব্যাপক হারে শিকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। বোস্টনের দুই সমাজকর্মী হ্যারিয়েট হেমানওয়ে এবং মিনা বি. হল, সমাজের উচ্চবিত্ত নারীদের পালকের পোশাক পরা থেকে বিরত করার জন্য চেষ্টা চালান।
তাঁরা অডুবন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করে। তাঁদের প্রচেষ্টায় ১৯১০ সালে নিউইয়র্কে পালক আইন তৈরি হয়, যেখানে সংরক্ষিত পাখির পালক বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯১৮ সালে, তারা একটি বড় সাফল্য পান: “Migratory Bird Treaty Act” নামক একটি ফেডারেল আইন তৈরি হয়, যা পরিযায়ী পাখি শিকার, ধরা বা বিক্রি করাকে অবৈধ ঘোষণা করে।
বর্তমানে, অনেক ফ্যাশন ডিজাইনার, যেমন ডোনাটেলা ভার্সাচি, জন গ্যালিয়ানো এবং প্রয়াত জর্জিও আরমানি, চামড়ার ব্যবহার বর্জন করেছেন।
গুচি, চ্যানেল, প্রাডা এবং বারবেরির মতো বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলোও চামড়া ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
পালকের ফ্যাশনের ভবিষ্যৎ কী?
ফেদার বা পালকের বিকল্প হিসেবে এখন তৈরি হচ্ছে প্ল্যান্ট-বেইজড “ফেভার্স”। এই ধরনের উদ্ভাবন ফ্যাশন জগতে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
তবে, নৈতিক ফ্যাশন কর্মী এমা হ্যাকানসন মনে করেন, “পালকের পরিবর্তে ফ্যাশন ডিজাইনাররা যদি উটপাখির পালক ব্যবহার করেন, তবে তা ভুল সিদ্ধান্ত হবে।” কারণ, উটপাখির পালক উৎপাদন প্রক্রিয়ায়ও শেষ পর্যন্ত পাখিগুলোকে হত্যা করা হয়।
কোপেনহেগেন ফ্যাশন উইক-এর রানওয়েতে বন্য প্রাণীজ উপাদান নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে হ্যাকানসন ও তাঁর দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়াও, তাঁরা ব্রিটিশ ফ্যাশন কাউন্সিলকে চামড়া ও বন্য প্রাণীর চামড়া ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে রাজি করিয়েছেন।
বর্তমানে নিউইয়র্ক, প্যারিস ও মিলানের আয়োজকদের সাথে তাঁরা একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য আলোচনা করছেন।
বাংলাদেশেও ফ্যাশন সচেতনতা বাড়ছে। এখানেও হয়তো খুব দ্রুতই এই ধরনের পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগবে।
তবে, আমাদের সংস্কৃতি ও রুচির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ফ্যাশনকে গ্রহণ করা উচিত।
তথ্যসূত্র: সিএনএন
 
                         
                         
                         
                         
                         
                         
				
			 
				
			 
				
			 
				
			