স্মার্টফোন আসক্তির যুগে ‘ডাম্বফোন’ -এর প্রত্যাবর্তন?
বর্তমান ডিজিটাল যুগে, স্মার্টফোন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত, এই যন্ত্রটি যেন আমাদের হাতের মুঠোয় বন্দী।
খবর দেখা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটানো থেকে শুরু করে জরুরি কাজ—সবকিছুই এর মাধ্যমে করা সম্ভব। তবে অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে মানসিক স্বাস্থ্য, ঘুমের সমস্যা এবং মনোযোগের অভাবসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে, অনেকেই স্মার্টফোন থেকে দূরে থাকার উপায় খুঁজছেন। কেউ চাইছেন ডিজিটাল দুনিয়া থেকে মুক্তি পেতে, আবার কেউ ডেটা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
অনেকে আবার প্রযুক্তির এই আগ্রাসন থেকে নিজেদের সন্তানদের বাঁচাতে চাইছেন। এইসব কারণে, ‘ডাম্বফোন’ বা সীমিত ফিচারের ফোনের চাহিদা বাড়ছে, যা একসময় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
‘ডাম্বফোন’ আসলে কী? এই ফোনগুলোতে স্মার্টফোনের মতো এত ফিচার থাকে না।
কল করা, মেসেজ পাঠানো, ক্যালেন্ডার এবং অ্যালার্মের মতো কিছু মৌলিক কাজই করা যায়। এক কথায়, এগুলো স্মার্টফোনের আগের প্রজন্মের ফোন।
বিশ্বজুড়ে এখনো ফিচার ফোনের বাজার বেশ বড়। বাজার গবেষণা সংস্থা কাউন্টার পয়েন্ট রিসার্চের বিশ্লেষক ইয়াং ওয়াংয়ের মতে, গত বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ২১ কোটি ফিচার ফোন বিক্রি হয়েছে, যার বাজারমূল্য ছিল ৩.২ বিলিয়ন ডলার।
যদিও উন্নত দেশগুলোতে স্মার্টফোনের জনপ্রিয়তা বাড়ায় এই ধরনের ফোনের বিক্রি কিছুটা কমতির দিকে।
কিন্তু এই পরিবর্তনের কারণ কী? এর পেছনে কাজ করছে স্মার্টফোন ব্যবহারের খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি।
অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারীরা তাদের সময় এবং মনোযোগ হারাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন অ্যাপ তাদের আকর্ষণ ধরে রাখার জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করে, যা এক ধরনের আসক্তি তৈরি করে।
এই সমস্যা সমাধানে কিছু কোম্পানি এগিয়ে এসেছে। তারা ‘ডাম্বফোন’ তৈরি করছে, যা স্মার্টফোনের বিকল্প হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, সুইস কোম্পানি ‘পнкт’ (Punkt) তৈরি করেছে এমন একটি ফোন, যা কল ও টেক্সট করার পাশাপাশি ক্যালেন্ডার এবং অ্যালার্মের মতো কিছু প্রয়োজনীয় সুবিধা দেয়।
কোম্পানিটি তাদের পণ্যের নকশায় ডিজিটাল মিনিমালিজম-এর ধারণা নিয়ে আসে, যা ব্যবহারকারীদের সীমিত ব্যবহারের সুযোগ দেয়।
আরেকটি কোম্পানি ‘লাইট’ (Light) তৈরি করেছে একটি ফোন, যা ব্যবহারকারীদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ডিজাইন করা হয়নি।
তাদের মূল লক্ষ্য হলো, ব্যবহারকারীদের সময় ফিরিয়ে দেওয়া এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় থেকে দূরে রাখা।
এই ফোনের ইন্টারফেস সাদামাটা এবং টেক্সট-ভিত্তিক, যা স্ক্রিন ব্যবহারের সময় কমাতে সাহায্য করে।
ফিনল্যান্ডের কোম্পানি এইচএমডি গ্লোবাল (HMD Global), যারা একসময় নোকিয়া ব্র্যান্ডের ফোন তৈরি করত, তারাও ফিচার ফোন তৈরি করছে।
তারা নোকিয়া ৩২১০ এবং নোকিয়া ২৬৬০ ফ্লিপ-এর মতো ক্লাসিক মডেল ফিরিয়ে এনেছে।
তাদের ফ্লিপ ফোনের বিক্রিও বেড়েছে, যা স্মার্টফোন থেকে দূরে থাকতে চাওয়া মানুষের আগ্রহের প্রমাণ।
তবে, ‘ডাম্বফোন’ তৈরি করা সহজ নয়।
ছোট আকারের কোম্পানি হওয়ায় তাদের উপকরণ এবং গবেষণা ও উন্নয়নে বেশি খরচ করতে হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ‘পнкт’-এর একটি ফোনের দাম ২৯৯ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩১ হাজার টাকার বেশি।
‘লাইট ফোন’-এর দাম ৬৯৯ ডলার, যা প্রায় ৭২ হাজার টাকার সমান।
এইচএমডি গ্লোবাল শিশুদের জন্য এইচএমডি ফিউজ (HMD Fuse) নামে একটি ফোন তৈরি করেছে, যেখানে প্যারেন্টাল কন্ট্রোলসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
এই ফোনে এমন একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যা নগ্ন ছবি শনাক্ত করতে পারে এবং সেই ধরনের ছবি দেখা গেলে ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর পক্ষে ‘ডাম্বফোন’ তৈরি করা কঠিন, কারণ এটি তাদের ব্যবসার মডেলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
তবে, মানুষের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারের খারাপ দিকগুলো নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে এবং তারা বিকল্প খুঁজছেন।
এই পরিবর্তনের ফলে হয়তো ভবিষ্যতে স্মার্টফোন বাজারে নতুন কিছু দেখা যেতে পারে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন