যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক (ফেড) কি ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে দেশটির শ্রমবাজারে ধস নামলে হস্তক্ষেপ করবে? এমন প্রশ্ন এখন জোরালো হচ্ছে, কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য নীতি একদিকে যেমন মূল্যস্ফীতি বাড়াচ্ছে, তেমনই কর্মসংস্থানকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ফেডের দ্বৈত ভূমিকা—মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা—একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
ফেডের মূল কাজ হলো মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং দেশের নাগরিকদের জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করা। সাধারণত, সুদের হার পরিবর্তন করে তারা এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের চেষ্টা করে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালের মন্দার সময় যখন ব্যাপক হারে কাজ হারানোর ঘটনা ঘটছিল, তখন ফেড সুদের হার কমিয়ে অর্থনীতিকে চাঙা করার চেষ্টা করেছিল। আবার, ২০২২ সালে যখন মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তখন তারা সুদের হার বৃদ্ধি করে অর্থনীতির গতি কমানোর পদক্ষেপ নেয়।
কিন্তু বর্তমানে, ফেড এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন, যা তারা বহু বছর দেখেনি। ট্রাম্পের শুল্ক নীতি একইসঙ্গে বেকারত্ব এবং মূল্যস্ফীতি—উভয়কেই উস্কে দিচ্ছে। এই শুল্ক যুদ্ধ ইতোমধ্যে মার্কিন ব্যবসা এবং ভোক্তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এমন পরিস্থিতিতে ফেড এখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।
ফেডের সর্বশেষ নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উচ্চ বেকারত্ব এবং মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বেড়েছে। ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলও স্বীকার করেছেন যে, স্থবির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির (stagflation) এই যুগলবন্দী তাদের জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, শুল্কের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি হয়তো সাময়িক হতে পারে। ফেডারেল রিজার্ভের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য ক্রিস্টোফার ওয়ালার সম্প্রতি এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “আগামী কয়েক মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে এবং বছরের শেষ নাগাদ তা আবার আমাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি চলে আসতে পারে।
তবে, সেন্ট লুইস ফেডের প্রেসিডেন্ট আলবার্তো মুসালেম সতর্ক করে বলেছেন, শুল্ক বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির প্রভাবকে সম্পূর্ণ অস্থায়ী হিসেবে ধরে নেওয়া উচিত হবে না। যদি মানুষ মনে করে যে, পণ্যের দাম আর স্বাভাবিক হবে না, অথবা সরবরাহ শৃঙ্খলে সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে।
অন্যদিকে, শ্রমবাজারে দুর্বলতা দেখা দিলে তা মূল্যবৃদ্ধির চাপ কমাতে পারে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ জেমস নাইটলি মনে করেন, “চাকরির বাজারে দুর্বলতার কোনো লক্ষণ দেখা দিলে, ফেড কিছুটা স্বস্তি পাবে এবং সুদের হার কমানোর মাধ্যমে অর্থনীতিকে আরও সহায়তা করতে পারবে।
এপ্রিল মাসে, মার্কিন অর্থনীতিতে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি, অর্থাৎ ১ লাখ ৭৭ হাজার নতুন চাকরি যুক্ত হয়েছে এবং বেকারত্বের হার ৪.২ শতাংশে স্থিতিশীল রয়েছে। তবে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বেড়ে যাওয়ায় এই চিত্র পরিবর্তন হতে পারে।
বোস্টন ফেডের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে অনেক কোম্পানি নতুন কর্মী নিয়োগ স্থগিত বা সীমিত করার পরিকল্পনা করছে।
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই বছর শুরুতে, দেশের মোট উৎপাদন (জিডিপি) কমেছে, যা ২০২১ সালের পর প্রথম।
শুল্কের আগে পণ্য কেনার হিড়িকে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি অনেক কমে গেছে।
গত বছর, ফেড শ্রমবাজারের দুর্বলতার প্রতি সংবেদনশীলতা দেখিয়েছিল। সেপ্টেম্বরে, তারা সুদের হার অর্ধ শতাংশ কমিয়ে দেয়, যখন বেকারত্ব বাড়ে এবং নিয়োগের হার কমে যায়।
যদিও পরিস্থিতি সাময়িক ছিল, ফেড দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছিল।
ওয়েলস ফার্গোর অর্থনীতিবিদ নিকোল সেভি বলেছেন, “ফেড সেই সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদের হার কমিয়েছিল। আমার মতে, জেরোম পাওয়েল কিছুটা নমনীয় এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও তিনি তেমন নীতি গ্রহণ করবেন।
ফেডের এমন নমনীয়তাকে ‘ডভিশ’ অ্যাপ্রোচ বলা হয়, যেখানে অর্থনীতির ক্ষতি বা শ্রমবাজারকে রক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। পাওয়েল সেই সময়কার এই পদক্ষেপের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, “তখন বেকারত্বের হার প্রায় ১ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল এবং শ্রমবাজারে খারাপ পরিস্থিতির আশঙ্কা ছিল।
তিনি আরও বলেন, “আমরা কয়েক বছর ধরে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করেছি এবং শ্রমবাজারের প্রতিও আমাদের সমর্থন রয়েছে, তা দেখানো জরুরি ছিল।
তথ্য সূত্র: সিএনএন