সাফল্যের পরেও কি আনন্দ নয়, শুধু একটা স্বস্তি?
আমরা যখন কোনো কাজ শেষ করি, তখন কি আনন্দ হয়? নাকি একটাই অনুভূতি কাজ করে – এই যাত্রায় ফেল করিনি, যা করেছি, তা ‘যথেষ্ট ভালো’? সাফল্যের আনন্দ উপভোগ করার বদলে, আমরা যেন পরের কাজের দিকে হাঁটা শুরু করি। মনে হয়, এই আনন্দটা অপ্রয়োজনীয়, কারণ কাজটি তো আমার দায়িত্বের মধ্যেই ছিল।
কিন্তু, নিজের সাফল্যে গর্ব অনুভব না করলে কি কিছু যায় আসে? ক্যালিফোর্নিয়ার একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ড. চু হুই চা-এর মতে, অবশ্যই যায়। তিনি বলেন, এমনটা হলে জীবনে এমন একটা পর্যায় আসতে পারে যেখানে—‘কিছুই যথেষ্ট ভালো লাগবে না, কোনো কিছুই ভালো লাগছে না, আর আপনি সবসময় আরও উঁচুতে উঠতে চাইবেন, সাফল্যের দৌড়ে এগিয়ে যেতে চাইবেন’। এমনটা হলে, তা দীর্ঘকালীন অসন্তুষ্টি আর মানসিক কষ্টের কারণ হতে পারে।
অন্যদিকে, নিজের সাফল্যে গর্ব অনুভব করা ভালো মানসিক স্বাস্থ্য, আত্ম-সম্মান এবং যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত।
তাহলে, কেন আমরা অনেকেই আমাদের জয় উদযাপন করতে পারি না? আসুন, এর কারণগুলো এবং কীভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ জেনে নিই।
আসলে, যারা ব্যর্থতাকে ভয় পান, তারা মনে করেন—কোনো কাজে সফল হওয়াটা যেন তাদের ব্যক্তি ও যোগ্যতার পরীক্ষা। তাদের আত্ম-মূল্য সাফল্যের সঙ্গে বাঁধা থাকে, তাই ব্যর্থতা তাদের জন্য অসহনীয় হতে পারে।
নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং অধ্যাপক ড. জেসিকা রলফিং প্রায়রের মতে, তারা ব্যর্থতাকে ভয় পান এবং যেকোনো মূল্যে তা এড়িয়ে যেতে চান। ড. চার মতে, যারা এমনটা অনুভব করেন, তারা একটি লক্ষ্য অর্জনের সময় হয়তো মানসিক চাপে থাকেন। কোনোভাবে যখন তারা লক্ষ্যে পৌঁছান, তখন তাদের মনে হয়—এই বুঝি ব্যর্থতা, লজ্জা আর প্রত্যাখান থেকে মুক্তি পাওয়া গেল।
কিন্তু চাপ, দুশ্চিন্তা আর ভয়ের মধ্যে থেকে ভালো লাগা বা গর্বের অনুভূতিতে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে।
এই সমস্যা কাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়? ড. চা-এর মতে, এমনটা সাধারণত সেইসব মানুষের মধ্যে দেখা যায়, যাদের পরিবারে সাফল্যের উচ্চ প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু সেই সাফল্যকে সেভাবে উদযাপন করা হতো না। এছাড়াও, পারফেকশনিস্ট বা সমালোচনামূলক বাবা-মায়েরাও এর জন্য দায়ী।
যেমন—অনেক এশীয়-আমেরিকান নারী এমন পরিবারে বেড়ে ওঠেন, যেখানে তাদের সফল হতে উৎসাহিত করা হতো, কারণ সফল হওয়াটাই ছিল সমালোচনার হাত থেকে বাঁচার উপায়।
এমনকি যদি অভিভাবক, শিক্ষক বা প্রশিক্ষকরা আপনার সাফল্য উদযাপন করতেন, তাহলেও প্রায়রের মতে, এটা আপনার মধ্যে আরও ভালো ফল করার চাপ তৈরি করতে পারে। তিনি আরও বলেন, অন্যদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে না পারলে, আপনি হয়তো ভালোবাসার অযোগ্য হয়ে উঠবেন—এমন একটা ভয় তৈরি হতে পারে।
যারা অসুস্থ ধরনের পারফেকশনিস্ট, তারা নিজেদের জন্য অত্যন্ত উচ্চ মান নির্ধারণ করেন এবং সেই মান পূরণ করতে না পারলে হতাশ হয়ে পড়েন। প্রায়রের মতে, তাদের মধ্যে ব্যর্থতা, লজ্জা এবং সামাজিক প্রত্যাখান এড়ানোর প্রবল মানসিকতা কাজ করে।
ড. প্রায়র যাদের চিকিৎসা করেন, তাদের অনেকের শৈশব ও কৈশোরে ব্যর্থতার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে, যখন তারা ব্যর্থ হন, তখন তাদের মধ্যে নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে দ্বিধা তৈরি হয়। এর ফলস্বরূপ, তারা ব্যর্থতা এড়ানোর জন্য অনেক বেশি চেষ্টা করেন।
দীর্ঘকাল ধরে দুশ্চিন্তায় ভোগা মানুষের মধ্যেও ব্যর্থতার ভয় থাকতে পারে। এছাড়াও, মনোযোগের ঘাটতি ও অতিসক্রিয়তা ব্যাধি (ADHD) আছে এমন অনেকে সাফল্যের পর স্বস্তি অনুভব করেন।
তাদের মতে, কোনো কাজ করা এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার সময় তাদের মধ্যে অপরাধবোধ ও লজ্জাবোধ জাগতে পারে। এছাড়াও, প্রত্যাখ্যান বা ব্যর্থতার কারণে তাদের তীব্র আবেগিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা ‘রিজেকশন সেনসিটিভিটি ডিসফোরিয়া’ নামে পরিচিত।
যখন তারা অবশেষে লক্ষ্য অর্জন করেন, তখন তাদের মনে হয়—যাক, কাজটি শেষ করতে পারলাম। এই অনুভূতি তাদের উদযাপন করতে দেয় না, বরং তারা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন।
তাহলে, কীভাবে নিজের সাফল্যে গর্ব অনুভব করবেন?
প্রথমত, সাফল্যের পেছনে আপনার কাছে থাকা উচ্চ প্রত্যাশার কারণগুলো খুঁজে বের করুন। ড. চা পরামর্শ দেন—কেন আপনার কাছে একটি সাফল্য এত গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন আপনি ব্যর্থ হতে ভয় পান, সে বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করুন।
আপনি কি মনে করেন, কিছু অর্জন করতে পারলেই আপনি মূল্যবান? ড. চার মতে, ‘আমাদের মূল্য আমাদের কাজ থেকে আসে না, বরং আমরা যেমন, তেমন থাকার মধ্যেই আমাদের মূল্য নিহিত’। যদি এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়, তাহলে একজন থেরাপিস্টের সঙ্গে কথা বলে আত্ম-মূল্য সম্পর্কে আপনার ধারণাগুলোর গভীরে যান।
ডা. চা আরও পরামর্শ দেন—যদি আপনি সফল না হন, তাহলে কী হবে, সেটা কল্পনা করুন এবং নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন—আপনি কতটা খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবেন। এটা আপনার উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করতে পারে। যদি ব্যর্থতার ভয় আপনার জীবনকে উপভোগ করতে বাধা দেয়, তাহলে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বড় লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো উদযাপন করুন। লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. অ্যামি মার্টিনেজের মতে, এই সময়ে সফলতার পাশাপাশি—কোন জিনিসগুলো আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা খুঁজে বের করা দরকার।
কাজটি করতে গিয়ে আপনি কী ঝুঁকি নিয়েছেন, কী শিখেছেন এবং কী অবদান রেখেছেন—সেগুলো দেখুন।
এগুলো হয়তো ADHD আছে এমন ব্যক্তিদের জন্য আরও সূক্ষ্ম হতে পারে। নিজেকে নির্দিষ্ট হতে উৎসাহিত করুন। যেমন—সকাল ৯টায় কাজ শুরু করার জন্য নিজেকে অভিনন্দন জানান, নাকি কাজটি করার সময় দুপুরের খাবার খেতে মনে রেখেছেন—এগুলো উদযাপন করুন।
ওহাইয়োর কেনিয়ন কলেজের মনোবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ড. লিয়া ডিকেন্স বলেন, ‘গর্বের মধ্যে আনন্দের চেয়ে বেশি মানসিক উপাদান রয়েছে’। ডিকেন্স আরও বলেন, মানুষ খুব সহজেই এবং স্বাভাবিকভাবেই আনন্দ অনুভব করে, কিন্তু নিজের সাফল্যে গর্ব অনুভব করার জন্য কিছুটা আত্ম-অনুসন্ধান প্রয়োজন।
প্রায়রের পরামর্শ—নিজেকে কিছু ‘কুদস’ দিন। এই মুহূর্তগুলো জোরে বলুন। পোস্ট-ইট-এ সেগুলো লিখুন এবং আপনার দেয়ালে বা জার্নালে রাখুন। বন্ধুদের সঙ্গে কফি বা রাতের খাবার উপভোগ করুন।
প্রায়র বলেন, গবেষণা দেখায় যে আচরণ পরিবর্তনের সাথে মনোভাব পরিবর্তনের দ্বিমুখী সম্পর্ক রয়েছে। আপনার আচরণ পরিবর্তন করলে, তা আপনার ভেতরের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
যদি ছোট জয়ে আনন্দ করার সময় আপনার মনে কোনো নেতিবাচক চিন্তা আসে, তবে সেটিকে বিচার না করে, তা সত্ত্বেও উদযাপন করুন।
ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো উদযাপন আপনাকে একটি ‘অভ্যন্তরীণ প্রশংসার কাঠামো’ তৈরি করতে সাহায্য করে। মার্টিনেজের মতে, যখন আপনি বড় লক্ষ্য অর্জন করবেন, তখন এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো মনে করুন।
চূড়ান্ত বিজয়ের আগে, ছোট ছোট উপায়ে উদযাপন করার কারণে বড় জয় উদযাপন করা আপনার কাছে কঠিন মনে হবে না।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান