রঙিন আলোর ঝলকানি আর শব্দে মুখরিত ফায়ারওয়ার্কস, যা দেখলে সকলেরই মন ভরে যায়। বর্ষবরণের রাতে কিংবা কোনো উৎসবে যখন আকাশে বাজি পোড়ানো হয়, তখন এক অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি হয়। নানা রঙের আলোর খেলা যেন রাতের আকাশকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
কিন্তু আপনারা কি জানেন, এই বাজিগুলোর পেছনের গল্পটা কী? কীভাবে তৈরি হয় এই বর্ণিল দৃশ্য? চলুন, আজ আমরা সেই রহস্যের গভীরে যাই।
ফায়ারওয়ার্কের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, এর জন্ম হয়েছিল বহু বছর আগে, প্রাচীন চীনে। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে এর সূত্রপাত। শুরুতে বাঁশের মধ্যে আগুন ভরে শব্দ তৈরি করা হতো।
এরপর ৬০০ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চীনা বিজ্ঞানীরা বারুদ আবিষ্কার করেন, যা ছিল কাঠকয়লা, পটাশিয়াম নাইট্রেট ও সালফারের মিশ্রণ। এই আবিষ্কারের ফলেই উন্নত বাজি তৈরির পথ খুলে যায়।
ক্রমে এই বারুদ বাঁশের বদলে কাগজ বা অন্য কোনো নলের মধ্যে ভরে ফায়ারওয়ার্কস তৈরি হতে শুরু করে। এরপর সং রাজবংশের (৯৬০-১২৭৯) সময়কালে বাজি ধর্মীয় ও উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়।
এর মাধ্যমে অশুভ শক্তিকে দূরে রাখা এবং শুভ অনুষ্ঠান উদযাপনের রীতি প্রচলিত হয়। ধীরে ধীরে এটি বিনোদনের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে ওঠে। ত্রয়োদশ শতকে চীন থেকে আসা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাজি ইউরোপে প্রবেশ করে এবং দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীতে এটি আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পরে।
এবার আসা যাক আসল কথায়, কীভাবে তৈরি হয় এই রং? আসলে, ফায়ারওয়ার্কসের প্রতিটি রঙের পেছনে রয়েছে এক একটি বিশেষ রাসায়নিক কৌশল।
বিভিন্ন ধাতব পদার্থকে পোড়ালে তারা ভিন্ন ভিন্ন রং তৈরি করে। যেমন, স্ট্রনটিয়াম (Strontium) ব্যবহারের ফলে লাল রং, সোডিয়াম (Sodium) হলুদ, কপার (Copper) নীল এবং টাইটানিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও জিরকোনিয়ামের (Zirconium) মিশ্রণে সাদা বা রূপালী রং পাওয়া যায়। এই ধাতুগুলোকে বারুদের সাথে মিশিয়ে নির্দিষ্ট রঙের বাজি তৈরি করা হয়।
শুধু রং নয়, বিভিন্ন ধরনের আকারের বাজি তৈরি করাও একটি বিশেষ শিল্প। হৃদয়ের আকার, তারা বা অন্য কোনো নকশা তৈরি করার জন্য বিস্ফোরক উপাদান দিয়ে তৈরি ছোট ছোট টুকরোগুলোকে বিশেষ আকারে সাজানো হয়। এরপর যখন বাজিটি আকাশে ওড়ে, তখন সেই টুকরোগুলো নির্দিষ্ট আকারে বিস্ফোরিত হয়, যা দর্শকদের মুগ্ধ করে।
বাজি তৈরি এবং ফোটানোর সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। বাজি ফোটানোর জন্য বাইরের কোনো উৎস যেমন – আগুন বা অন্য কোনো উপাদানের প্রয়োজন হয়। তাই বাজিগুলোকে এমন জায়গায় রাখতে হবে যেখানে আগুন লাগার সম্ভাবনা নেই।
এছাড়াও, আর্দ্রতা ও সরাসরি সূর্যের আলো থেকেও বাজিকে দূরে রাখতে হবে।
ফায়ারওয়ার্কস-এর এই মনোমুগ্ধকর জগৎ আসলে বিজ্ঞান, কারিগরি এবং ঐতিহ্যের এক দারুণ মিশ্রণ। বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার আর সুনিপুণ কারুকার্যের মাধ্যমে এটি সম্ভব হয়।
তাই, পরের বার যখন কোনো বাজি উৎসব দেখবেন, তখন এর পেছনের বিজ্ঞান আর শিল্পকলা সম্পর্কে বন্ধুদের জানাতে পারেন।
তথ্য সূত্র: ট্রাভেল অ্যান্ড লেজার