অস্ট্রেলিয়ার নতুন ‘গ্রেট ওয়াক’: ভয়ঙ্কর ইতিহাস আর প্রকৃতির মেলবন্ধন!

ফ্লিন্ডার্স দ্বীপ: অস্ট্রেলিয়ার নতুন ‘গ্রেট ওয়াক’-এ প্রকৃতির শোভা ও এক শোকগাঁথা।

অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়া রাজ্যের একটি দ্বীপ, ফ্লিন্ডার্স। পর্যটকদের কাছে এখনো সেভাবে পরিচিতি না পেলেও, এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেকোনো ভ্রমণকারীর মন জয় করতে পারে। স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর সাদা বালুকাময় সৈকত দেখলে মনে হয় যেন ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে এসে পরেছেন।

আবার এখানকার পাথরের গায়ে লেগে থাকা কমলা রঙের লাইকেন (lichen)-এর ছোঁয়া জানান দেয়, এটি তাসমানিয়ারই অংশ। সম্প্রতি, এই দ্বীপটি অস্ট্রেলিয়ার ত্রয়োদশ ‘গ্রেট ওয়াক’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

‘গ্রেট ওয়াক’ হলো অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের বন্য প্রকৃতির মাঝে কয়েক দিনের জন্য পায়ে হেঁটে ঘোরার অভিজ্ঞতা। এই ধরনের ভ্রমণে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা থাকে। অভিজ্ঞ গাইডরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে এই ভ্রমণে নেতৃত্ব দেন।

সাধারণত, এদের সঙ্গে উন্নতমানের খাবার, ওয়াইন এবং থাকার সুব্যবস্থা থাকে।

ফ্লিন্ডার্স দ্বীপের আকর্ষণীয় দিক হলো এর নির্জনতা। মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় এখানে পর্যটকদের আনাগোনা অনেক কম।

ব্রিটিশ নাবিক ম্যাথিউ ফ্লিন্ডার্স ১৮০১ থেকে ১৮০৩ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া প্রদক্ষিণ করার সময় এই দ্বীপের নামকরণ করেন। ৫১৫ বর্গমাইলের এই দ্বীপে রয়েছে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, পাহাড় এবং সুন্দর সমুদ্র সৈকত।

এখানকার রাস্তাগুলো পাকা নয় এবং স্থানীয় মানুষের চেয়ে ওয়াল্লাবি (এক ধরনের ক্যাঙ্গারু) নামক প্রাণীটির সংখ্যা বেশি। তাসমানিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে ছোট বিমান অথবা নৌকায় করে এখানে পৌঁছানো যায়।

এখানে আসা পর্যটকদের জন্য রয়েছে আরামদায়ক ‘ইকো-কমফোর্ট ক্যাম্প’। এখানকার আকর্ষণীয় হাঁটা পথের মধ্যে অন্যতম হলো মাউন্ট কিলি-ক্রাঙ্কির চারপাশের পথ। এখানকার পাথরের গঠন অনেকটা বিশালকায় ওম্বাট (এক প্রকার প্রাণী)-এর মতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দ্বীপে বসবাস করা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাসও বেশ বেদনাদায়ক।

ফ্লিন্ডার্স দ্বীপে আদিবাসী ‘পালাওয়া/পাকানা’ সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। তারা প্রায় ৪,০০০ বছর আগে এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যায়। তবে তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার কিছু নিদর্শন এখনো এখানে খুঁজে পাওয়া যায়।

এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো ‘উইবালেন্না’। এক সময় এখানে আদিবাসীদের একটি বসতি ছিল।

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় তাদের উপর চালানো হয়েছিল চরম নির্যাতন। ১৮০৩ সালে তাসমানিয়ায় প্রায় ১৫,০০০ ‘পালাওয়া/পাকানা’ আদিবাসী ছিল।

কিন্তু, ১৯৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা কমে ৩০০-এর কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। জর্জ অগাস্টাস রবিনসন নামের এক ব্যক্তি আদিবাসীদের ফ্লিন্ডার্স দ্বীপে পুনর্বাসিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

কিন্তু, বাস্তবে তাদের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি তাদের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছিল।

ভয়াবহ জীবনযাত্রার কারণে ১৮৪৭ সাল নাগাদ এই বসতির জনসংখ্যা মাত্র ৪৭ জনে এসে ঠেকেছিল।

আজকের দিনে ফ্লিন্ডার্স দ্বীপের জীবনযাত্রা ভিন্ন। উনিশ শতকের শেষের দিকে এখানে ‘ফ্রি হোল্ড ল্যান্ড’ চালু হওয়ার পর এই দ্বীপের চিত্র বদলে যায়।

বর্তমানে এখানকার প্রায় ১০০০ মানুষের জীবনযাত্রা কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল।

ফ্লিন্ডার্স দ্বীপের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট স্ট্রজলেকি জয় করার পর এখানকার স্থানীয় ‘ফ্লিন্ডার্স ইন্টারস্টেট হোটেল’-এ বসে এখানকার জীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা যায়। এখানকার মানুষেরা জানান, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার জন্যই তারা এই দ্বীপে থাকতে ভালোবাসেন।

প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আর ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই দ্বীপটি পায়ে হেঁটে ঘোরার জন্য সত্যিই অসাধারণ।

যারা এই দ্বীপে ভ্রমণ করতে চান, তাদের জন্য হাঁটা পথগুলো সহজ থেকে মাঝারি মানের। দিনে প্রায় সাত ঘণ্টা হাঁটার মতো শারীরিক সক্ষমতা থাকতে হবে।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *