সুখী হওয়া আর পরিপূর্ণ জীবন যাপন করা – দুটো কি একই জিনিস? সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, সবসময় নয়।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভালো থাকা, অর্থাৎ ‘পূর্ণতা’ (flourishing) – এর ধারণাটি নিছক ব্যক্তি-সুখের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত। স্বাস্থ্য, আর্থিক নিরাপত্তা, সম্পর্কের গভীরতা, জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া – এই সবকিছু মিলেই একজন মানুষের ‘পূর্ণতা’।
গবেষণাটি বলছে, মানুষের ‘পূর্ণতার’ মাপকাঠিতে শীর্ষ স্থান অধিকার করেছে ইন্দোনেশিয়া। এরপর রয়েছে মেক্সিকো এবং ফিলিপাইন।
বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনযাত্রার এই দিকটি নিয়ে গবেষণাটি করেছে ‘গ্লোবাল ফ্লাওয়ারিশিং স্টাডি’ (Global Flourishing Study)। গবেষণাটি পরিচালনা করেছে বায়লার ইউনিভার্সিটির ‘ইনস্টিটিউট ফর স্টাডিজ অফ রিলিজিয়ন’ এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ‘হিউম্যান ফ্লাওয়ারিশিং প্রোগ্রাম’।
এর সঙ্গে সহযোগী হিসেবে ছিল গ্যালুপ এবং সেন্টার ফর ওপেন সায়েন্স। ২২টি দেশ এবং চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হংকং-এ এই গবেষণা চালানো হয়েছে।
গবেষণায় অংশ নিয়েছেন প্রায় ২ লক্ষ ৭ হাজার মানুষ। তাঁদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন, অনেক দেশেই ‘পূর্ণতার’ ধারণাটি প্রচলিত সুখের ধারণার চেয়ে ভিন্ন।
উদাহরণস্বরূপ, সুখী দেশের তালিকায় উপরের দিকে থাকা অনেক দেশ ‘পূর্ণতার’ দিক থেকে ততটা এগিয়ে নেই।
গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে, যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেটি হলো, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘পূর্ণতার’ অভাব।
অনেক দেশেই দেখা যাচ্ছে, বয়স্কদের তুলনায় তরুণরা জীবনে কম সুখী। পোল্যান্ড এবং তানজানিয়ার মতো কয়েকটি দেশে অবশ্য তরুণদের মধ্যে ‘পূর্ণতার’ হার বেশি।
গবেষকরা মনে করেন, উন্নত দেশগুলোতে ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি হয়, যা তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ বাড়ায়। এছাড়া, সামাজিক উন্নতির সুযোগ কমে যাওয়ায় অনেক তরুণ হতাশ হয়ে পড়েন।
গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোতে আর্থিক নিরাপত্তা বেশি থাকলেও, জীবনের গভীরতা, ভালো সম্পর্ক এবং অন্যের প্রতি দয়া প্রদর্শনের মতো বিষয়গুলোতে তারা পিছিয়ে আছে।
গবেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, কীভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে জীবনের অর্থ এবং সম্পর্কের গভীরতা বজায় রাখা যায়?
আশ্চর্যজনকভাবে, যে দেশগুলো ‘পূর্ণতার’ দিক থেকে এগিয়ে আছে, তাদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া সবার উপরে। ফিলিপাইন এবং নাইজেরিয়ার স্থানও বেশ ভালো।
অথচ, এই দেশগুলো সুখী দেশের তালিকায় প্রথম সারিতে নেই। আবার, সুইডেন সুখী দেশের তালিকায় চতুর্থ স্থানে থাকলেও, ‘পূর্ণতার’ বিচারে তাদের স্থান মাঝের দিকে।
তাহলে, কীভাবে একজন মানুষ তাঁর জীবনে ‘পূর্ণতা’ আনতে পারে? গবেষকরা বলছেন, এর কিছু দিক আমাদের হাতে রয়েছে।
মানুষের জীবনের ‘পূর্ণতা’ পরিমাপের জন্য গবেষণায় ১২টি মূল প্রশ্ন ব্যবহার করা হয়েছে।
এর মাধ্যমে নিজের জীবনকে নতুন করে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কারো যদি সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা থাকে, তবে এই প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে নিজের উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া সহজ হতে পারে।
গবেষকরা আরও বলছেন, উন্নত দেশগুলো ছাড়াও অন্যান্য অনেক দেশেও ভালো জীবন যাপন করা সম্ভব। মানুষের ভালো থাকার জন্য পারস্পরিক সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যারা ধর্মীয় বা সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়, তাঁদের মধ্যে ভালো থাকার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
তবে, জীবনের কিছু দিক আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক সংকট অথবা কোনো সংঘাত মানুষের জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
মানুষের জীবনে ‘পূর্ণতা’ আনতে হলে, সমাজের কাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধানে মনোযোগ দিতে হবে।
আপনার জীবনে ‘পূর্ণতা’ আছে কিনা, তা জানতে চাইলে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারেন:
- আপনি কি আপনার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট?
- আপনার কি জীবনের উদ্দেশ্য আছে?
- আপনি কি ভালো স্বাস্থ্য উপভোগ করেন?
- আপনার কি ভালো বন্ধু এবং পরিবারের সদস্য আছেন?
- আপনি কি আর্থিক দিক থেকে নিরাপদ?
- আপনি কি নতুন কিছু শিখতে আগ্রহী?
- আপনি কি ইতিবাচক মানুষ?
- আপনি কি আপনার সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত?
- আপনি কি আপনার দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে অবগত?
- আপনি কি ভালোবাসেন এবং ভালোবাসার প্রতিদান পান?
- আপনি কি আপনার জীবনে কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন?
- আপনি কি অন্যদের সাহায্য করেন?
জীবনকে আরও সুন্দর ও পরিপূর্ণ করে তোলার জন্য, এই গবেষণা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়।
তথ্য সূত্র: CNN