খাদ্য বিষয়ক একটি গবেষণাকে বিতর্কিত করতে স্বার্থান্বেষী মহলের মদতে চালানো হয় কুৎসা ও অপপ্রচারের এক পরিকল্পিত প্রচারণা। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি গোপন নথিতে এমনটাই জানা গেছে।
২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইট-ল্যানসেট কমিশন’ নামক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে পরিবেশের উপর খাদ্য উৎপাদন ও গ্রহণের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের সুরক্ষায় খাদ্য বিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেওয়া হয়।
গবেষণাটিতে বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়। বিশেষ করে, গরুর মাংসের ব্যবহার কমিয়ে বাদাম, শস্য ও অন্যান্য উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পশুপালন থেকে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কমাতে সহায়তা করবে। এই প্রস্তাবনার পরেই মূলত বিতর্ক শুরু হয়।
প্রকাশিত হওয়া মাত্রই এই গবেষণাটির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। গবেষকদের ব্যক্তিগতভাবে হুমকি দেওয়া হয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁদের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়। শুধু তাই নয়, এই গবেষণাটিকে সমালোচনা করে কয়েক’শ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট ‘DeSmog’-এর হাতে আসা গোপন নথি থেকে জানা যায়, ‘রেড ফ্ল্যাগ’ নামক একটি জনসংযোগ সংস্থা এই সমালোচনামূলক প্রচারণার মূল হোতা ছিল। সংস্থাটি ‘অ্যানিমেল এগ্রিকালচার অ্যালায়েন্স’-এর প্রতিনিধিত্ব করে। এই অ্যালায়েন্সটি মূলত মাংস ও দুগ্ধ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের একটি জোট, যারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে থাকে। এই জোটের সঙ্গে কার্গিল ও স্মিথফিল্ড ফুডসের মতো বৃহৎ মাংস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও যুক্ত ছিলেন।
ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যায়, ‘ইট-ল্যানসেট’ প্রতিবেদন প্রকাশের দুই সপ্তাহের মধ্যে এই প্রচারণার মূল বার্তাগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মূলধারার গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘ইট-ল্যানসেট’-এর প্রস্তাবিত খাদ্য তালিকা এবং এর সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীদের ‘ভণ্ড’ হিসেবে উপস্থাপন করা।
নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গবেষণাটি প্রকাশের পর এর বিরুদ্ধে প্রকাশিত হওয়া ১,৩১৫টি নিবন্ধের প্রায় অর্ধেকের বেশি নিবন্ধে রেড ফ্ল্যাগের দেওয়া বক্তব্য ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও, ১০৩টি নিবন্ধে গবেষকদের ভণ্ডামি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, যা পরবর্তীতে টুইটারে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
এই প্রচারণার অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের ‘স্পেক্টেটর’ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যেখানে খাদ্য তালিকা পরিবর্তনের পরিকল্পনার সমালোচনা করা হয়। এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই গবেষণাটিকে ‘বিপজ্জনক’ এবং ‘গরিব মানুষের জন্য মাটির খাবার’ খাওয়ার মতো পরামর্শ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে, এই প্রচারণায় রেড ফ্ল্যাগের ভূমিকা ঠিক কতটুকু ছিল, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত গবেষকদের একজন ড. মার্কো স্প্রিংম্যান জানান, এই প্রচারণার ফলে তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। তিনি বলেন, সাধারণত বছরে ২-৩টি গবেষণা পরিচালনা করলেও, এই বিতর্কের কারণে তিনি একটিও গবেষণা করতে পারেননি।
গবেষণায় যুক্ত হওয়া আরেকজন বিজ্ঞানী ড. লিন গর্ডন জানান, গবেষণা প্রকাশের পর তিনি তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন, যা তাঁর জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। গবেষণাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. গানহিল্ড স্টোরডালেন এবং তাঁর স্বামী, নরওয়েজিয়ান ব্যবসায়ী পিটার স্টোরডালেনকেও ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য বিষয়ক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এমন প্রচারণা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি সংস্কৃতি যুদ্ধের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিক্টর গ্যালাজ বলেন, “আলোচনার এই আগ্রাসী রূপ দেখে সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক গবেষণায় এমনটা আগে দেখা গেলেও, খাদ্য এবং মাংসের ক্ষেত্রে এটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন।”
গবেষকরা জানান, তাঁরা তাঁদের গবেষণার বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানান। তবে, তাঁরা মনে করেন, এই ধরনের আক্রমণাত্মক প্রচারণা কোনো ফল বয়ে আনে না।
যদিও রেড ফ্ল্যাগ সরাসরি গবেষকদের উপর ব্যক্তিগত আক্রমণের সঙ্গে জড়িত ছিল না, তবে গবেষকরা মনে করেন, তাদের এই প্রচারণা বিতর্কটিকে আরও উস্কে দিয়েছে।
এই সমালোচনার পরও ‘ইট-ল্যানসেট’ প্রতিবেদনটি খাদ্য ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষণায় অত্যন্ত প্রভাবশালী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এবং নীতিনির্ধারকরা তাঁদের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই গবেষণাটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন।
দ্বিতীয় ‘ইট-ল্যানসেট’ প্রতিবেদন প্রকাশের প্রাক্কালে ড. স্প্রিংম্যান আশা প্রকাশ করেন, নতুন গবেষণাটি আরও গঠনমূলক আলোচনার জন্ম দেবে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান