শিরোনাম: প্রিমিয়ার লিগে টিকিটের দাম বৃদ্ধি: নিয়মিত দর্শকদের কি কোণঠাসা করা হচ্ছে?
প্রতি বছর, এই সময়ে ফুটবল ক্লাবগুলো তাদের দীর্ঘদিনের টিকিট গ্রাহকদের কাছে ই-মেইল পাঠায়, যেখানে জানানো হয় আগামী মৌসুমে খেলা দেখার জন্য কত খরচ হবে। অনেক সময়, এই ইমেইলগুলো আসে কোনো দাম বাড়ার খবর ছাড়াই।
প্রথমে তারা আর্থিক চ্যালেঞ্জ এবং মালিকপক্ষের সাফল্যের জন্য বিনিয়োগের পরিকল্পনার কথা জানায়। সাধারণত, আনুগত্যের জন্য বেশি দাম নেওয়াটা তাদের জন্য একটি “কঠিন, কিন্তু প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত” হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু অনেক ভক্তের কাছে এটা এখন মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে (ইপিএল) বর্তমানে টেলিভিশন চুক্তি এবং পুরস্কারের অর্থ অনেক বেড়ে যাওয়ায়, নিয়মিত খেলা দেখতে আসা দর্শকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়টি বেশ বেমানান মনে হচ্ছে। ক্লাব মালিক ও পরিচালকরা ভালো করেই জানেন, ভক্তরা তাদের প্রিয় দলের খেলা দেখতে নিয়মিত আসবেন।
ফুটবল অনেকের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা তাদের দ্বিতীয় বাড়ির মতো স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যেতে চান এবং এর জন্য অন্য খরচ কমাতে প্রস্তুত থাকেন।
এ বছর এগারোটি প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব তাদের টিকিটের দাম ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে পাঁচটি ক্লাব টিকিটের দাম বাড়ায়নি (লিভারপুল, ওয়েস্ট হ্যাম, টটেনহ্যাম, লেস্টার এবং ব্রেন্টফোর্ড)।
আর ছয়টি ক্লাব টিকিটের দাম বাড়িয়েছে। নিউক্যাসল, ব্রাইটন ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে টিকিটের দাম গড়ে ৫% বেড়েছে।
নটিংহ্যাম ফরেস্টের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি হয়েছে সর্বোচ্চ ৮.৫% পর্যন্ত। আর্সেনালের টিকিটের দাম তাদের সিটের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে হয় ৩% বা ৫% বেড়েছে।
এভারটন তাদের নতুন স্টেডিয়ামে টিকিটের দাম বাড়াচ্ছে। জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৩%।
আগে, টিকিট গ্রাহকদের ক্লাবের প্রাণ হিসেবে দেখা হতো। বসন্তকালে টিকিট বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ গ্রীষ্মকালীন খেলোয়াড় কেনার পরিকল্পনা করতে সাহায্য করত।
কিন্তু প্রিমিয়ার লিগে টেলিভিশন চুক্তি থেকে আসা বিপুল পরিমাণ অর্থের কারণে পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন ক্লাবগুলো বেশি মনোযোগ দেয় বেশি দামে একটি ম্যাচের টিকিট বিক্রি করার দিকে।
এমনকি কিছু ক্লাব আগের টিকিট গ্রাহকদের টিকিট বিক্রি করে না।
প্রিমিয়ার লিগের নিয়ম অনুযায়ী, ক্লাবগুলোকে টিকিটের দামে ছাড় দিতে হয়, কিন্তু এই ছাড়ের সংজ্ঞা নির্দিষ্ট নয়।
কিছু ক্লাব শুধুমাত্র মাঠের কিছু নির্দিষ্ট অংশে ছাড় দেয়, যাতে তারা প্রিমিয়াম সিটগুলো বেশি দামে বিক্রি করতে পারে। তরুণ ভক্ত এবং আগামী প্রজন্মের খেলা দেখার সুযোগ তৈরি করতে এই নিয়মগুলোর পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
পরিবহন খরচ, খাবার ও পানীয়ের দাম বাড়ার কারণে খেলা দেখতে যাওয়া আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।
ক্লাবের পক্ষ থেকে হয়তো বিষয়গুলো সেভাবে ভাবা হয় না, কারণ এগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
ফুটবল সাপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (এফএসএ) দীর্ঘদিন ধরে ‘স্টপ এক্সপ্লয়টিং লয়্যালটি’ নামে একটি ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে, যার উদ্দেশ্য হলো ভক্তদের একত্রিত করা এবং তাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করা।
কিছু ক্লাব তাদের সমর্থকদের সঙ্গে ভালো আলোচনা করে, তবে এফএসএ-এর একজন মুখপাত্র বলেছেন, “আমাদের কিছু উদ্বেগ আছে যে ক্লাবগুলো সময় মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে না, যা উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া এবং আলোচনার সুযোগ দেয়।
লিগের ভক্তরা মনে করেন, ঐতিহ্যবাহী ইংরেজি সংস্কৃতি থেকে ক্লাবগুলো দূরে সরে যাচ্ছে এবং তারা আশঙ্কা করছেন, ক্লাবগুলো অর্থ-কেন্দ্রিক এজেন্ডা ব্যবহার করছে, যা শেষ পর্যন্ত ক্লাবের সমর্থনের ওপর প্রভাব ফেলবে।”
ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে আগামী মৌসুমে কিছু পরিবর্তন আসবে।
সেখানে দীর্ঘদিন ধরে খেলা দেখতে আসা দর্শকদের তাদের সিট থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে, যাতে সেই জায়গাগুলো ‘হসপিটালিটি স্পট’ হিসেবে ব্যবহার করা যায়, যা অনেক বেশি দামে বিক্রি করা সম্ভব।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বিষয়টি পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে: “হোম ও অ্যাওয়ে ডাগআউটের পাশে থাকা সাধারণ আসনের কিছু টিকিট হসপিটালিটি সিটে রূপান্তরিত করা হবে, যা এই অনন্য স্থানের উচ্চ মূল্য প্রতিফলিত করবে।”
ইতিমধ্যে ইতিহাদ স্টেডিয়ামে ‘টানেল ক্লাব’ এবং চেলসি তাদের মাঠের একই অবস্থানে খেলা দেখার জন্য টিকিটের দাম ১২,৫০০ পাউন্ড (প্রায় ১৬,০০,০০০ বাংলাদেশী টাকা, যা বিনিময় হারের উপর নির্ভরশীল) পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে।
অনেকের কাছে এই কর্পোরেট সংস্কৃতি হয়তো সহজে গ্রহণ যোগ্য নয়, তবে বেশিরভাগ ভক্ত প্রিমিয়ার লিগের এই পরিবর্তনটা বুঝতে পারেন।
কিছু খেলোয়াড়ের জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ করার কারণে অন্য খাতে টিকিটের দাম কমানো যেত, কিন্তু তেমনটা হচ্ছে না।
নতুন স্টেডিয়াম তৈরি হলে, সেখানে টিকিটের নতুন পরিকল্পনা করার সুযোগ থাকে।
ভবিষ্যতে হয়তো সিটের দুই-তৃতীয়াংশ কম দামে বিক্রি করা হবে এবং প্রিমিয়াম সিটগুলোর দাম বাড়ানো হবে। নতুন স্টেডিয়ামের পরিকল্পনা নিয়ে ক্লাবগুলোতে এমন আলোচনা শোনা যাচ্ছে, তবে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কিছু নির্দিষ্ট এলাকার দর্শকদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা যেতে পারে, যেমন আলাদা খাবার বা পণ্যের ব্যবস্থা করা।
কারণ, তাদের চাহিদা নিয়মিত দর্শকদের থেকে ভিন্ন হতে পারে।
ক্লাবগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে।
ফুটবলের অভিজ্ঞতা শুধু মাঠের খেলা নয়, গ্যালারির পরিবেশও এর অংশ।
যারা একটিমাত্র খেলা দেখতে আসেন, তারা একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা চান এবং সেই পরিবেশ তৈরি করেন নিয়মিত দর্শকরা।
কিন্তু যদি তাদের টিকিটের দামের কারণে দূরে থাকতে হয়, তাহলে স্টেডিয়ামে নীরবতা নেমে আসবে, যা খেলা দেখতে আসা দর্শক এবং টিভি দর্শকদের জন্য ক্ষতিকর হবে।
এফএসএ বলছে, “ক্লাবগুলো বিশাল সম্প্রচার এবং স্পন্সরশিপ চুক্তি থেকে বিপুল লাভ করে, যা টিকিটের আয় থেকে অনেক বেশি।
টিকিটের দামে সামান্য বৃদ্ধিও ভক্তদের উপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলে, যা ক্লাবের তেমন কোনো উপকারে আসে না।
এই অর্থ উপার্জনের কৌশল স্টেডিয়ামের পরিবেশ এবং প্রিমিয়ার লিগের মূল ভিত্তি—স্থানীয় সমর্থনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
আমরা ভক্ত হিসেবে বিশ্বের সেরা হতে চাই।
আমরা এটা তৈরি করতে সাহায্য করেছি—এটি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।”
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।