বাকস্বাধীনতা: ফাঁকা বুলি নাকি অস্ত্রের খেলা?

মুক্তচিন্তা: একটি বিতর্কিত ধারণা, যা যুগে যুগে ভিন্ন রূপে হাজির হয়েছে।

আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, বাকস্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা। কেউ একে রক্ষার কথা বলেন, আবার কেউ এর অপব্যবহারের দিকটি তুলে ধরেন। সম্প্রতি প্রকাশিত ফারা দাবহোইওয়ালার একটি বই, ‘হোয়াট ইজ ফ্রি স্পিচ? দ্য হিস্টরি অফ আ ডেঞ্জারাস আইডিয়া’–এই বিতর্কের গভীরে প্রবেশ করে।

বইটিতে বাকস্বাধীনতার ধারণার বিবর্তন এবং এর সঙ্গে ক্ষমতা ও অর্থের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

দাবহোইওয়ালার মতে, আধুনিককালে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বাকস্বাধীনতাকে একটি “অস্ত্র” হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এই ধারণাকে কাজে লাগায়। তাঁর মূল প্রশ্ন হল, আমরা কি বাকস্বাধীনতাকে একটি চরম অধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে পারি, নাকি এর আরও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ প্রয়োজন?

বইটিতে বাকস্বাধীনতার উৎপত্তিস্থল অনুসন্ধান করতে গিয়ে লেখক ১৭২০-২৩ সালের ‘ক্যাটো’স লেটার্স’-এর কথা উল্লেখ করেছেন। এই বেনামী পত্রিকার কলামগুলো মূলত দুজন সাংবাদিক, থমাস গর্ডন এবং জন ট্রেঞ্চার্ডের লেখা ছিল। তাঁদের যুক্তিতর্কগুলো যদিও তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু উত্তর আমেরিকার বিদ্রোহীরা এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করে।

এরপর লেখক দৃষ্টি দেন জন স্টুয়ার্ট মিলের ১৮৫৯ সালের বিখ্যাত রচনা ‘অন লিবার্টি’র দিকে। মিল বাকস্বাধীনতাকে ব্যক্তির অধিকার হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর মতে, চিন্তা ও মতপ্রকাশ অভিন্ন এবং এর মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

তবে দাবহোইওয়ালা মনে করেন, মিলের এই ধারণাটি দুর্বল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, কারণ এর মাধ্যমে বাকস্বাধীনতার সামাজিক প্রভাবকে অস্বীকার করা হয়।

ঐতিহাসিকভাবে, বাকস্বাধীনতার ধারণা বিভিন্ন সময়ে ভিন্নভাবে প্রয়োগ হয়েছে। ঔপনিবেশিক ভারতে, ব্রিটিশ সরকার বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে একটি “উন্নয়নমূলক” হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত, তবে এর মাধ্যমে তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখত। এমনকি স্বাধীনতার পরেও, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে মানহানি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিরুদ্ধে কঠোর আইন তৈরি করা হয়।

বর্তমান সময়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ, কোভিড-১৯ বিষয়ক ভুল তথ্য প্রচার, এমনকি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর মতো ঘটনার পেছনেও তাদের ভূমিকা ছিল। এই প্রেক্ষাপটে, বাকস্বাধীনতার নামে কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণে শিথিলতা একটি উদ্বেগের বিষয়।

দাবহোইওয়ালা বাকস্বাধীনতার বিরোধী নন, বরং তিনি এর আরও গভীর উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, বাকস্বাধীনতা শুধু শব্দের বিষয় নয়, বরং কোন কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে এবং কাদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, সেই বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ।

ফারা দাবহোইওয়ালার এই বইটি, বাকস্বাধীনতার মতো একটি জটিল বিষয়কে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে উৎসাহিত করে। আমাদের সমাজে বাকস্বাধীনতা নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে, এই বইটি সেই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *