এখনও দুঃস্বপ্ন: মুক্তি পাওয়া জিম্মিদের চোখে, ফিলিস্তিনে আটকে থাকা স্বজনদের হাহাকার!

**গাজায় এখনও বন্দী থাকা স্বজনদের জন্য উদ্বিগ্ন মুক্তি পাওয়া ইসরায়েলি জিম্মিরা**

প্রায় চার মাস আগে হামাসের বন্দীশালা থেকে মুক্তি পাওয়া কিথ সিগেল এখনো ভুলতে পারেননি গাজায় কাটানো ৪8৪ দিনের বিভীষিকাময় স্মৃতি।

সেখানকার টানেলে এখনও বন্দী থাকা জিম্মিদের কথা ভেবে প্রতিদিন তিনি কষ্ট পান।

মার্কিন-ইসরায়েলি দ্বৈত নাগরিক সিগেল বলেন, “আমার মনে হয়, তারা যেসব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তা ভাবলে আমি শিউরে উঠি।

সেইসব চিন্তা থেকে যেন মুক্তি নেই।

শুধু বন্দী অবস্থায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া কিংবা সেখানকার দমবন্ধ করা পরিবেশ আর অপুষ্টির কথাই ভাবেন না সিগেল।

ইসরায়েলের লাগাতার বোমা হামলা এবং স্থল অভিযান তাঁর মনে গভীর আতঙ্ক তৈরি করেছে।

তাঁর ভয়, অবশিষ্ট জীবিত জিম্মিরা হয়তো নিহত হবেন, অথবা হামাস তাদের হত্যা করবে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েল থেকে ২৫১ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।

যুদ্ধ শুরুর ৬০০ দিন পার হওয়ার পর, মুক্তি পাওয়া জিম্মি সিগেল এবং আরো অনেকে, এখনো বন্দী ৫8 জনের মুক্তির জন্য একটি চুক্তির আবেদন জানাচ্ছেন।

তাঁরা চান, অবিলম্বে এই সংঘাতের অবসান হোক।

বুধবার তেল আবিবে বিক্ষোভকারীরা রাস্তা অবরোধ করে এবং “হোস্টেজ স্কয়ার”-এ ও মার্কিন দূতাবাসের সামনে জড়ো হয়ে ইসরায়েলি সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে, যাতে হামাসের সঙ্গে আলোচনা করে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা যায়।

ওমের শেম-টোভ, যিনি যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার আগে মুক্তি পাওয়া শেষ জিম্মিদের একজন, তাঁর মধ্যে সবসময় এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে।

খাবার খাওয়ার সময় তিনি ভাবেন, যারা এখনো বন্দী, তারা হয়তো খাবার পাচ্ছে না।

গোসল করার সময় তাঁর মনে হয়, গাজায় বন্দী থাকা মানুষগুলো হয়তো এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

গলায় হাত দিয়ে তিনি বলেন, “আমি যেন দম বন্ধ হয়ে আসা অনুভব করি।”

সিগেলের মতোই মুক্তি পাওয়া অনেকেই তাঁদের নতুন জীবন উৎসর্গ করেছেন গাজায় আটকে পড়া স্বজনদের মুক্ত করার জন্য।

২২ বছর বয়সী শেম-টোভ মনে করেন, বন্দী মানুষগুলো তাঁর ভাই ও বোনের মতো।

তাঁদের দুঃখ-কষ্ট তিনি গভীরভাবে অনুভব করেন।

তিনি বলেন, “আমি আমার পরিবারের জন্য লড়াই করব।

তাঁরা নরকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।

সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েলের অধিকাংশ মানুষ চায়, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হোক।

বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষেরা এই আন্দোলনের সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর।

তাঁদের মতে, গাজায় আটকে পড়াদের জন্য কিছু করা তাঁদের পবিত্র দায়িত্ব।

শেম-টোভ বলেন, “হামাসকে নির্মূল করার চেয়ে জিম্মিদের জীবন এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

অন্যদিকে, সিগেল বন্দীজীবনে তাঁর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন এবং অবশিষ্ট জিম্মিদের ঝুঁকির বিষয়টি বারবার বলছেন।

উত্তরা ইসরায়েলে তাঁর মেয়ের বাড়ি থেকে কথা বলার সময় সিগেলের চেহারায় সুস্থতার ছাপ দেখা যায়।

বন্দী অবস্থায় হারানো ওজন ফিরে পেয়েছেন তিনি, মুখের রঙও আগের মতো হয়েছে।

পরিবার ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাচ্ছেন তিনি।

কিন্তু তাঁর মন সবসময় গাজার টানেলে আটকে থাকে।

তাঁর মনে পড়ে যান মাতান অ্যাংরেস্ট নামের ২২ বছর বয়সী এক ইসরায়েলি সেনা সদস্য এবং ওমরি মিরান নামের দুই সন্তানের জনক, ৪৮ বছর বয়সী এক ব্যক্তির কথা, যাঁদের সঙ্গে তিনি বন্দী ছিলেন।

সিগেল বলেন, “আমি তাঁদের কথা প্রতিদিন, দিনে বহুবার ভাবি।

তাঁদের জন্য আমার উদ্বেগ হয়—আমি তাঁদের খুব মিস করি।”

সিগেল ও মিরান প্রায় পাঁচ মাস একসঙ্গে বন্দী ছিলেন।

এই সময়ে তাঁরা তাঁদের পছন্দের গান এবং পরিবারের প্রতি ভালোবাসার কথা আলোচনা করতেন।

মিরানের দুই মেয়ে—আলমা ও রনি, এখন যাদের বয়স ২ ও ৪ বছর।

সিগেলের মুখে তাঁদের নামগুলো সহজেই আসত।

সিগেল বলেন, “ওমরির জন্য তাঁর মেয়েদের বাবা ছাড়া বড় হওয়া এবং তাদের বেড়ে ওঠা দেখা থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি ভাবাটা খুব কঠিন ছিল।”

গত মাসে হামাস কর্তৃক প্রকাশিত একটি ভিডিওতে মিরান সরাসরি সিগেলের উদ্দেশ্যে কথা বলেছিলেন।

সিগেল বলেন, তাঁর সহবন্দীকে দেখে মনে হয়েছিল, তিনি “পুরোপুরি বদলে গেছেন—খারাপের দিকে।”

অ্যাংরেস্টের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে বাবা-ছেলের সম্পর্কের মতো বলতে দ্বিধা বোধ করেন সিগেল।

তবে এটা স্পষ্ট যে, তাঁরা একটি বিশেষ বন্ধন তৈরি করেছিলেন।

৬৭ দিন তাঁরা একটি ছোট কক্ষে বন্দী ছিলেন, একটিমাত্র বিছানা ভাগ করে নিয়েছিলেন।

অ্যাংরেস্ট সিগেলকে আরবি শিখতে সাহায্য করেছিলেন, ম্যাকাবি হাইফা ফুটবল দলের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা বলতেন এবং মুক্তির পর তাঁর বাবা-মায়ের বাড়িতে একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।

সিগেল জানান, তিনি, অ্যাংরেস্ট ও মিরান প্রায়ই প্রার্থনা করতেন, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যেন তাঁদের সাহসী অভিযানে উদ্ধার করে।

কিন্তু আগস্ট মাসে হামাস যখন ইসরায়েলি সেনাদের কাছাকাছি আসার পরে ৬ জন জিম্মিকে হত্যা করে, তখন তাঁদের সব স্বপ্ন ভেঙে যায়।

সিগেল বন্দী অবস্থাতেই এই খবর পান এবং তাঁর স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।

সিগেল বলেন, “আমি ভয় পেয়েছিলাম, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যদি আমাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে, তাহলে হয়তো আমি অপহরণকারীদের হাতে নিহত হব।

এখনো যারা সেখানে আছে, তাদের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলের সামরিক অভিযান বাড়লে জিম্মিদের জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হবে।

যদিও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী অবশিষ্ট জিম্মিদের কোনো ক্ষতি না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সিগেল বলেন, “যুদ্ধ জিম্মিদের জীবন কেড়ে নিয়েছে।

আমার মনে হয়, জিম্মিদের ফিরিয়ে এনে এই ঘটনাগুলো এড়ানো যেতে পারে।

এর সমাধান হলো, তাঁদের ফিরিয়ে আনা—এমন একটি চুক্তিতে পৌঁছানো, যা তাঁদের মুক্তি দেবে।”

শেম-টোভও একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

তাঁর মতে, বন্দী অবস্থায় সবচেয়ে ভয়ের মুহূর্ত ছিল যখন তাঁর চারপাশে ইসরায়েলি বোমা পড়ছিল।

তিনি বলেন, সেই বোমাগুলো এতটাই শক্তিশালী ছিল যে “যে কোনো মুহূর্তে আপনার জীবন কেড়ে নিতে পারে।”

শেম-টোভ বলেন, “আমি আমার নিজের মানুষের হাতে, আমার ভাইদের হাতে মারা যেতে ভয় পেতাম।”

সিগেল ও শেম-টোভ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং জিম্মিদের মুক্তির জন্য একটি চুক্তি করার ওপর জোর দিয়েছেন।

যদিও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, হামাসকে পরাজিত করা জিম্মিদের মুক্ত করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, অনেক জিম্মি-সমর্থক ট্রাম্পের উপর ভরসা রাখছেন।

সিগেল বলেন, “তাঁর (ট্রাম্প) প্রচেষ্টার কারণেই আমি আজ মুক্ত।

আমি বিশ্বাস করি, তিনি এটা করতে চান এবং এটি তাঁর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি আমাদের তা বলেছেন।

আমি তাঁকে অনুরোধ করছি, তিনি যেন দ্রুত একটি চুক্তি করেন এবং তাঁদের সবাইকে ফিরিয়ে আনেন।”

শেম-টোভও বিশ্বাস করেন, ট্রাম্পের কারণেই তিনি মুক্তি পেয়েছেন।

মার্চ মাসে হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে তাঁদের সাক্ষাতে ট্রাম্প তাঁকে বলেছিলেন, “তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।”

শেম-টোভ বন্দী অবস্থায় প্রায় ২৫ কেজি ওজন হারিয়েছিলেন।

শুরুতে তিনি প্রতিদিন সামান্য কিছু রুটি ও পনির খেতেন।

পরে একটি বিস্কুটে এসে ঠেকেছিল তাঁর খাবার।

তবে তিনি জানান, ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর হামাসের আচরণে কিছু পরিবর্তন আসে, যেমন—তাঁকে বেশি খাবার দেওয়া হতো।

শেম-টোভ আরও বলেন, হামাস তাঁকে “গালি দেওয়া ও থুথু ফেলা বন্ধ করে দেয়।”

তিনি প্রায়ই তাঁর অপহরণকারীদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন এবং তাঁরা চাইতেন, কমলা হ্যারিস যেন মার্কিন নির্বাচনে জয়ী হন।

শেম-টোভ বলেন, “ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা বুঝতে পেরেছিল, তিনি জিম্মিদের ঘরে ফিরিয়ে আনতে চান।”

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *