ফের ‘পুরনো রূপে’ ফিরছে প্রজাতি? ডারউইনের দ্বীপের টমেটোর নজির!

বিপ্লবের পথে: গ্যালাপাগোসের টমেটোর ‘পশ্চাৎ বিবর্তন’ কি নতুন দিগন্ত?

চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের জন্মস্থান গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা! এখানে বুনো টমেটোর একটি প্রজাতি, *সোলোনাম পেনেলাই*, যেন কয়েক মিলিয়ন বছর আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা একে ‘পশ্চাৎ বিবর্তন’ বলছেন, যা জীববিজ্ঞানের চিরাচরিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

গ্যালাপাগোসের এই দ্বীপপুঞ্জ, ইকুয়েডরের উপকূল থেকে কয়েকশ মাইল দূরে অবস্থিত। বিজ্ঞানীরা যখন এখানকার টমেটোগুলো নিয়ে গবেষণা করছিলেন, তখন তাদের চোখে পড়ে এক ভিন্ন চিত্র।

বিশেষ করে দ্বীপপুঞ্জের অপেক্ষাকৃত তরুণ পশ্চিমা দ্বীপগুলোতে জন্মানো *সোলোনাম পেনেলাই* টমেটোগুলো এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান তৈরি করছে যা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আর দেখা যায়নি।

এই উপাদানগুলো হলো অ্যালকালয়েড, যা উদ্ভিদের এক প্রকার প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে কাজ করে।

গবেষকরা এরপর বয়স্ক দ্বীপগুলোতে পাওয়া *সোলোনাম পেনেলাই* নমুনার সঙ্গে এই তরুণ দ্বীপের টমেটোগুলোর তুলনা করেন। তারা দেখেন, বয়স্ক দ্বীপের টমেটোগুলোতে আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান, যেখানে তরুণ দ্বীপের টমেটোগুলো যেন তাদের পূর্বপুরুষদের মতোই আচরণ করছে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিভারসাইডের আণবিক জীববিজ্ঞানী অ্যাডাম জোয়াক বলেন, “পশ্চাৎ বিবর্তন” খুব একটা দেখা যায় না।

তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা মনে করি পরিবেশগত পরিস্থিতির কারণে এই টমেটোগুলো তাদের আদি অবস্থায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে।

এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে প্রকৃতি অত্যন্ত নমনীয় এবং বিবর্তন কেবল একমুখী প্রক্রিয়া নয়।

তরুণ দ্বীপের টমেটোগুলোর ফল কিছুটা বেগুনী রঙের এবং তাদের লতা গাঢ় বর্ণের। তবে মূল পার্থক্যটা ধরা পড়েছে তাদের অণু-পর্যায়ে।

বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, এই টমেটোগুলোর অণুর গঠন অনেকটা বেগুন গাছের মতোই।

বেগুনও নাইটশেড পরিবারের সদস্য এবং তাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল।

আধুনিক টমেটোতে যেখানে এই অ্যালকালয়েড তৈরির ক্ষমতা নেই, সেখানে গ্যালাপাগোসের পশ্চিমা দ্বীপের টমেটোগুলো যেন সেই প্রাচীন বৈশিষ্ট্যটি পুনরায় ফিরে পেয়েছে।

এই আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এখন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছেন – কেন টমেটোগুলো তাদের পুরনো জিনে ফিরে যাচ্ছে?

এর মাধ্যমে তারা খাদ্যশস্য, শক্তিশালী কীটনাশক এবং ঔষধ তৈরির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারেন। এমনকি বিবর্তন বিষয়ে আমাদের ধারণা আরও গভীর হতে পারে, যা মানুষসহ অন্যান্য প্রজাতির বিবর্তনকে বুঝতে সাহায্য করবে।

প্রায় ১ থেকে ২ মিলিয়ন বছর আগে পাখির মাধ্যমে *সোলোনাম পেনেলাই* দক্ষিণ আমেরিকা থেকে গ্যালাপাগোসে আসে।

জোয়াকের মতে, তরুণ দ্বীপগুলোর সৃষ্টি হয়েছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে।

তাই এই টমেটোগুলোর বিবর্তন সম্ভবত শেষ পাঁচ লক্ষ বছরের মধ্যে ঘটেছে।

গ্যালাপাগোসের পূর্বাঞ্চলের দ্বীপগুলোতে পরিবেশ তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল এবং জীববৈচিত্র্যপূর্ণ।

অন্যদিকে, তরুণ দ্বীপগুলোতে অনুর্বর ভূমি এবং কম উন্নত মাটি দেখা যায়।

জোয়াকের ধারণা, আদিম জিনের অধিকারী টমেটোগুলোর বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান শুধু কীটপতঙ্গ থেকে তাদের রক্ষা করে না, বরং মাটির পুষ্টি সংগ্রহ করতে এবং রোগের বিরুদ্ধেও সাহায্য করতে পারে।

গবেষকরা দেখেছেন, অ্যামিনো অ্যাসিডের সামান্য পরিবর্তনের কারণেই এই পশ্চাৎ বিবর্তন ঘটেছে।

তারা একই পদ্ধতিতে তামাক গাছের জিনগত পরিবর্তন করে এই প্রাচীন উপাদানগুলোর উৎপাদন পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করেছেন।

তবে এই পরিবর্তনের সুবিধা কী, এবং কেন এই পশ্চাৎ বিবর্তন ঘটছে, তা জানতে আরও গবেষণা প্রয়োজন বলে জানান জোয়াক।

কর্নেল ইউনিভার্সিটির বিবর্তনীয় বাস্তুবিজ্ঞানী অনুরাগ আগারওয়াল মনে করেন, *সোলোনাম পেনেলাই* এর এই ঘটনা বিভিন্ন পরিবেশে উদ্ভিদের বিচিত্র রাসায়নিক পরিবর্তনের প্রমাণ।

তবে তিনি এই টমেটোর পশ্চাৎ বিবর্তনকে খুব একটা অস্বাভাবিক মনে করেন না।

মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এরিক হাগ বলেন, বিবর্তন সাধারণত একমুখী প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি পরিবর্তন এবং পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া।

তিনি ডলোর সূত্রটির কথা উল্লেখ করেন, যেখানে বলা হয় একবার কোনো বৈশিষ্ট্য বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়ে গেলে, সেটি একই পথে আর ফিরে আসে না।

উদাহরণস্বরূপ, তিমিদের কথা বলা যেতে পারে, যারা একসময় স্থলচর ছিল, কিন্তু পরে সমুদ্রে ফিরে আসে।

তবে, টমেটোগুলোর ক্ষেত্রে যা ঘটছে, তা ডলোর সূত্রকে কিছুটা চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

কারণ, এই টমেটোগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে কিছু দিক দিয়ে আলাদা।

এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

অন্যদিকে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেথ শাপিরো মনে করেন, এই ‘পশ্চাৎ বিবর্তন’ শব্দটি বিবর্তন সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বাড়াতে সহায়ক।

জোয়াক মনে করেন, পরিবেশগত চাপ এবং প্রতিযোগিতার কারণে বিবর্তন ঘটে।

তিনি আরও বলেন, অতীতের পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রজাতিগুলোর মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল, পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই বৈশিষ্ট্যগুলো ফিরে আসতে পারে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *