গাজায় মানবিক সহায়তা ব্যবস্থা: সাহায্যের নামে আসলে কি চলছে?
গত মাসের শেষের দিকে, রাফাহ শহরে ত্রাণ বিতরণের স্থানে খাবার সংগ্রহের জন্য হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ছুটে গিয়েছিলেন। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে তাদের এই ছুটে চলা। কিন্তু সেখানে তাদের স্বাগত জানাতে এগিয়ে এল ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মী, এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করে। অনেকের কাছেই রাফাতে যা ঘটেছিল, তা ছিল এক হৃদয়বিদারক ঘটনা।
কিন্তু যারা পরিস্থিতি ভালো করে জানেন, তাদের কাছে এটি ছিল একটি উদ্বেগের বিষয়। তাদের মতে, মানবিকতার মোড়কে এখানে সাম্রাজ্যবাদেরই জয় হয়েছে।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা, যা ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট, তারা গাজায় সাহায্য বিতরণের একটি নতুন কেন্দ্র চালু করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল, জাতিসঙ্ঘের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং হামাসের দুর্নীতিমুক্ত একটি ব্যবস্থা তৈরি করা।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এটি ছিল নিয়ন্ত্রণের এক নতুন কৌশল। ক্ষুধার্ত মানুষগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা তীব্র রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে সামান্য কিছু খাবার পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছিল। তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল লোহার খাঁচা, যেখানে গাদাগাদি করে তারা দাঁড়িয়ে ছিল।
এক পর্যায়ে যখন তাদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়, তখন নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের ওপর গুলি চালায়। এমনকি ইসরায়েলি হেলিকপ্টার থেকে সতর্কতামূলক গুলিও চালানো হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সাহায্য বিতরণের কাজটি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।
সাহায্যের নামে এখানে যা দেওয়া হচ্ছিল, তা ছিল অপমানজনক। খাবারের পরিমাণ ছিল খুবই সামান্য, যা দিয়ে কোনোমতে জীবন বাঁচানো যায়। পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সবজি বা গাছ লাগানোর জন্য বীজ কিছুই ছিল না।
ছিল শুধু প্রক্রিয়াজাত করা কিছু খাবার, যা দিয়ে সেখানকার মানুষকে একটি সংকটপূর্ণ অবস্থার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখা যায়, যেন তারা তাদের ধ্বংসকারীদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকে।
রাফাহর ওই ঘটনার ছবিগুলো দেখলে গত শতাব্দীর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা মনে পড়ে যায়। যেখানে মানুষগুলোকে পশুর মতো লোহার খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল, খাবারের জন্য তারা বন্দুকের নলের দিকে তাকিয়ে ছিল।
গাজার এই সাহায্য বিতরণ কেন্দ্রগুলো যেন আজকের দিনের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। এখানকার মূল উদ্দেশ্য হলো, সাহায্য করার বদলে অবাঞ্ছিত একটি জনসমষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করা।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জ্যাক উড, বিতরণের এই বিশৃঙ্খলার কয়েক দিন আগে পদত্যাগ করেন। তিনি তার পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন, তিনি মানবিকতার নীতিগুলো অনুসরণ করতে পারছেন না।
সাহায্য বিতরণের নামে সেখানে যা চলছিল, তা ছিল একটা মিথ্যাচার। যারা গাজার জনগণকে সাহায্য করার কথা বলছে, তারা যদি দখলদার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে, তবে তাদের নিরপেক্ষ থাকার কোনো সুযোগ নেই।
ফিলিস্তিনিদের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্তর্ভুক্ত না করে, অথবা তাদের উপর খাদ্য সংকটের দায় চাপিয়ে, এই সাহায্য কোনোভাবেই নিরপেক্ষ হতে পারে না।
জাতিসংঘের খাদ্য অধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত মাইকেল ফাকরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় ‘ক্ষুধা চাপিয়ে দেওয়ার’ অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, বোমা ও গুলির চেয়ে এখানে দুর্ভিক্ষ ও রোগ বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটাচ্ছে।
তার মতে, আধুনিক ইতিহাসে এত দ্রুত এবং পরিকল্পিতভাবে ক্ষুধা সংকট তৈরি হয়নি। শুধু মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে, অবরোধের মধ্যে গাজায় মাত্র ১০৭টি ত্রাণ ট্রাক প্রবেশ করতে পেরেছিল। অথচ যুদ্ধবিরতির সময় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ ট্রাকের প্রয়োজন ছিল।
ফিলিস্তিনিরা গত ৭৬ বছর ধরে এই ধরনের ‘সাহায্য’ নামক প্রতারণার শিকার হচ্ছে। ১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’ (দুর্দশা) তাদের জীবন সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে।
একসময় ফিলিস্তিনিরা খাদ্য উৎপাদন করত এবং নিজেদের প্রয়োজন মেটাত। কিন্তু নাকবার পর তারা সাহায্য প্রার্থনাকারী একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের কৃষক এখন জাতিসঙ্ঘের রেশন সংগ্রহের জন্য লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হয়।
তাদের জলপাই বাগানগুলো এখন অন্যদের সন্তানদের খাদ্য যোগায়।
যুক্তরাষ্ট্র, যারা জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থার (ইউএনআরওয়া) প্রধান অর্থদাতা, তারাই আবার গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য অস্ত্র সরবরাহ করে। একদিকে ধ্বংসযজ্ঞ, অন্যদিকে সেই ধ্বংসের শিকার হওয়া মানুষদের জন্য সামান্য কিছু ত্রাণ—এটাই যেন সাম্রাজ্যবাদের কৌশল।
মানুষকে বাঁচিয়ে রাখো, কিন্তু তাদের বাঁচতে দিও না। সাহায্য করো, কিন্তু তাদের মুক্তি দিও না।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন এই ব্যবস্থার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখানে বেসরকারি ঠিকাদারদের মাধ্যমে সাহায্য বিতরণ করা হয়, যা দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সমন্বিত।
ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব কোনো প্রতিষ্ঠানকে এখানে কাজ করতে দেওয়া হয় না। এটি যেন মানবিকতার মোড়কে চালানো একটি সামরিক কৌশল, যা উপনিবেশবাদেরই নামান্তর।
ফিলিস্তিনিরা ভালো করেই জানে, ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া কোনো সাহায্য তাদের মুক্তি দিতে পারবে না। তারা জানে, কারাগারের মতো জায়গায় সামান্য কিছু খাবার দিয়ে সম্মানজনক জীবন পাওয়া যায় না।
‘কারামাহ’ (মর্যাদা)—এই শব্দটির অর্থ হলো সম্মান, আত্মমর্যাদা এবং স্বাধীনতা। এটি আকাশ থেকে ফেলা যায় না, কিংবা চেকপোস্টে পাওয়া যায় না।
ফিলিস্তিনিদের কারামাহ তাদের মধ্যেই রয়েছে—তাদের প্রতিরোধের মধ্যে, তাদের টিকে থাকার অদম্য ইচ্ছার মধ্যে।
তাদের প্রয়োজন প্রকৃত মানবিক সহায়তা, যা শুধু ক্যালোরি সরবরাহ করবে না, বরং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও তৈরি করবে। তাদের মুক্তি তখনই আসবে, যখন অবরোধ ভেঙে দেওয়া হবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে, এবং ফিলিস্তিনের জমি তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
যতদিন না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সত্য উপলব্ধি করতে পারবে, ততদিন পর্যন্ত ইসরায়েল ও তার মিত্ররা নিপীড়নের এই কৌশলকে ত্রাণ হিসেবে চালিয়ে যাবে। রাফাহর মতো হৃদয়বিদারক দৃশ্যগুলো আমরা হয়তো আরও অনেক বছর ধরে দেখতে থাকব।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা