গাজায় ত্রাণ পাঠাবে যুক্তরাষ্ট্র! কিন্তু…

গাজায় মানবিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে একটি নতুন মার্কিন-সমর্থিত সংস্থা গঠিত হয়েছে। তবে, এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো। ইসরায়েলের অবরোধের মধ্যে এই সহায়তা কার্যক্রম কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

গাজা মানবিক ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের এই নতুন সংস্থাটি জানিয়েছে, তারা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণ বিতরণ শুরু করবে। তাদের দাবি, ইসরায়েলের অনুমোদন তাদের রয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে প্রায় ১৯ মাস ধরে চলা যুদ্ধ এবং খাদ্য, জল ও চিকিৎসা সামগ্রীর ওপর ইসরায়েলের অবরোধের কারণে চরম খাদ্য সংকটে পড়া গাজাবাসীর কিছুটা হলেও উপকার হবে।

জাতিসংঘের একটি প্যানেলের তথ্য অনুযায়ী, গাজার অর্ধেকের বেশি মানুষ বর্তমানে ‘জরুরি’ অথবা ‘বিপর্যয়কর’ খাদ্য সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তবে, এই ফাউন্ডেশনটি শুরু থেকেই শীর্ষস্থানীয় মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোর সমালোচনার শিকার হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, এই সহায়তা অপর্যাপ্ত এবং এটি বেসামরিক নাগরিকদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। এমনকি তাদের জোরপূর্বক স্থানান্তরেরও কারণ হতে পারে।

আসলে, ইসরায়েল কেন গাজায় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে? হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর, গত ২ মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজার ওপর সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে। ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দাবি, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল হামাসকে নতুন যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে নিতে এবং গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আটক হওয়া জিম্মিদের মুক্তি দিতে বাধ্য করা।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই হামাসের বিরুদ্ধে গাজাবাসীর জন্য পাঠানো ত্রাণ আত্মসাৎ করার অভিযোগ তুলেছে। যদিও হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে, ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, খাদ্য সহায়তার সিংহভাগই ক্ষতিগ্রস্ত বেসামরিক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।

তবে, আসল কারণ যা-ই হোক না কেন, এর ফল স্পষ্ট। হামাসের হামলার অনেক আগে থেকেই গাজায় খাদ্য সংকট বিদ্যমান ছিল। এরপর ইসরায়েল ত্রাণ সরবরাহের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। এমনকি, অক্টোবর ২০২৩ এর আগেও ইসরায়েল ও মিশর গাজার ওপর আংশিক অবরোধ আরোপ করেছিল, যার ফলে সেখানকার ৬৩ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গাজার শতভাগ মানুষ খাদ্য সংকটে রয়েছে। প্রায় ৭০ হাজার শিশুর জরুরি ভিত্তিতে অপুষ্টির চিকিৎসা প্রয়োজন।

গাজা মানবিক ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) আসলে কী? এটি একটি অলাভজনক সংস্থা, যা মার্কিন সরকারের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য হলো, গাজায় খাদ্য সংকট নিরসন করা। একইসঙ্গে, ইসরায়েলের শর্ত অনুযায়ী, এই সহায়তা যেন হামাসের হাতে না যায়, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে।

গত সপ্তাহে জেরুজালেমে এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি এই সংস্থার কিছু লক্ষ্যের কথা তুলে ধরেন। সংস্থাটির নেতৃত্বে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্য জ্যাক উড। তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য ‘টিম রুবিকন’ প্রতিষ্ঠা করেন।

জিএইচএফ তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছে, ‘সহায়তা বিতরণে বাধা, যুদ্ধ এবং সীমিত access-এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে জীবন রক্ষাকারী সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না, যা দাতাদের আস্থাকেও ক্ষুণ্ণ করেছে। জিএইচএফ একটি স্বাধীন এবং কঠোরভাবে নিরীক্ষিত মডেলের মাধ্যমে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে সহায়তা পৌঁছে দিতে কাজ করবে।’

সংস্থাটি তাদের প্রাথমিক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ডেভিড Beasley (বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সাবেক নির্বাহী পরিচালক) এবং ন্যাট মুকের (ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের সাবেক প্রধান)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেয়। যদিও পরে জানা যায়, এই দুই ব্যক্তি বর্তমানে গাজা মানবিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করছেন না।

সহায়তা কীভাবে কাজ করবে? ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, তারা গাজার প্রায় ২১ লাখ মানুষের মধ্যে ১২ লাখ মানুষকে খাওয়ানোর জন্য ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ স্থাপন করবে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এখানে ‘প্যাকেটজাত রেশন, স্বাস্থ্যবিধি কিট এবং চিকিৎসা সামগ্রী’ সরবরাহ করা হবে। এই সহায়তা ‘নিরাপদে নিয়ন্ত্রিত করিডোর’-এর মাধ্যমে বিতরণ করা হবে এবং এর ওপর নজরদারি করা হবে। সংস্থাটি আর্থিক অনুদানের পাশাপাশি খাদ্য ও অন্যান্য সরাসরি ত্রাণ সামগ্রীও গ্রহণ করবে।

জিএইচএফ জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করবে। তবে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বে থাকবে বেসরকারি সামরিক ঠিকাদাররা। এর মধ্যে একটি মার্কিন firm-ও রয়েছে, যারা চলতি বছরের শুরুতে যুদ্ধবিরতির সময় সেখানে কাজ করেছে।

সংস্থাটি বুধবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলের কাছে বিদ্যমান পদ্ধতির মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা প্রবেশের অনুমতি চেয়েছে। তবে, ইসরায়েল এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এতে রাজি হয়নি।

গাজা মানবিক ফাউন্ডেশন খাদ্য ও অর্থের সংস্থান করবে কীভাবে? এখনো পর্যন্ত তা স্পষ্ট নয়। জিএইচএফ জানিয়েছে, তারা ‘মানবিক সংস্থাগুলোর বিদ্যমান অঙ্গীকারের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ খাদ্য সহায়তা সংগ্রহের চূড়ান্ত পর্যায়ে’ রয়েছে। এর মাধ্যমে তারা ৩০০ মিলিয়নের বেশি খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবে। তবে, তারা সরবরাহকারীদের নাম প্রকাশ করেনি।

হাকাবি গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এমন কিছু ব্যক্তি আছেন, যারা এরই মধ্যে অর্থ দিতে রাজি হয়েছেন, কিন্তু তারা এখনই তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না।’

জাতিসংঘের ভূমিকা কী? গাজায় ফিলিস্তিনিদের খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছে জাতিসংঘ। বিশেষ করে, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থা (ইউএনআরওয়া)-এর সঙ্গে ইসরায়েলের দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলে আসছে।

ইসরায়েল সরকারের অভিযোগ, ইউএনআরওয়ার কর্মীরা গত ৭ অক্টোবরের হামলায় জড়িত ছিলেন। যদিও সংস্থাটি অভিযুক্তদের বেশিরভাগকে বরখাস্ত করেছে, কিন্তু ইসরায়েল তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ জমা দেয়নি। এর ফলস্বরূপ, ইসরায়েলি পার্লামেন্ট ইউএনআরওয়াকে ইসরায়েলে কাজ করতে নিষিদ্ধ করেছে, যা জাতিসংঘের নেতৃত্বে পরিচালিত মানবিক কার্যক্রমকে কঠিন করে তুলেছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জাতিসংঘ নতুন মার্কিন-সমর্থিত গাজা সহায়তা উদ্যোগে অংশ নিতে অস্বীকার করেছে। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক প্রধান একে ‘নিষ্ঠুর প্রহসন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

জাতিসংঘ ও অন্যান্য ত্রাণ সংস্থাগুলোর প্রধান আপত্তি হলো, জিএইচএফ যে পদ্ধতিতে কাজ করতে চাইছে, তা কিছু মৌলিক মানবিক নীতি লঙ্ঘন করে। জাতিসংঘের সতর্কবার্তা অনুযায়ী, যেহেতু শুরুতে এই সহায়তা কেবল গাজার দক্ষিণাঞ্চলে এবং কেন্দ্রে বিতরণ করা হবে, তাই এটি ইসরায়েলের সেই লক্ষ্যেরই প্রতিফলন ঘটাবে, যেখানে তারা উত্তর গাজার ‘পুরো জনসংখ্যাকে’ সরিয়ে দেওয়ার কথা বলছে।

জাতিসংঘ বলছে, সহায়তা বিতরণের দায়িত্বে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সরাসরি বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ অংশগ্রহণে সহায়তা গ্রহীতারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি, বেসরকারি সামরিক ঠিকাদাররা crowd control-এর জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। বর্তমানে গাজায় ৪০০টি বিতরণ কেন্দ্র রয়েছে। নতুন এই প্রোগ্রামের অধীনে সেখানে হাতেগোনা কয়েকটি কেন্দ্র থাকবে, যা মানুষকে অনেক দূর হেঁটে ভারী রেশন নিয়ে যেতে বাধ্য করবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও জিএইচএফ উভয়ই জোর দিয়ে বলছে, এটি কোনো ইসরায়েলি উদ্যোগ নয়। যদিও ইসরায়েল এই প্রকল্পের সমর্থন করছে এবং বিতরণ কেন্দ্রগুলো চিহ্নিত ও সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করছে।

জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তার মূল্যায়নে বলেন, ‘এটি গাজার একটি অংশে সহায়তা সীমাবদ্ধ করে, যেখানে অন্যান্য জরুরি চাহিদাগুলো অপূর্ণ থাকে। এটি রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্যের সঙ্গে সহায়তাকে শর্তযুক্ত করে। এটি দুর্ভিক্ষকে দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এটি একটি নিষ্ঠুর প্রহসন, যা আরও সহিংসতা ও বাস্তুচ্যুতির দিকে ঠেলে দেয়।’

তথ্য সূত্র: সিএনএন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *