যুদ্ধবিরতির আলোচনা: গাজায় মৃত্যুর মিছিল, বাড়ছে হাহাকার!

গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা ভেঙে যাওয়ায় সেখানে প্রতিদিন বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজার বিভিন্ন অংশে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, যার ফলে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছেই।

একদিকে যখন শান্তির আলোচনা কার্যত থমকে আছে, অন্যদিকে গাজায় ফিলিস্তিনিদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে ইসরায়েলি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র।

দোহায় নতুন করে যুদ্ধবিরতির আলোচনার জন্য প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু কয়েক দিন ধরে চলা আলোচনার পর দুই পক্ষই একে অপরের উপর দোষারোপ করছে, যার ফলে কোনো সমাধানে আসা যাচ্ছে না। এর মধ্যে, গত মার্চ মাসে যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান চলছেই।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজার হাসপাতালগুলোতে ১৩৯ জনের মৃতদেহ আনা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন।

এই সংখ্যাটি গত ২ জুলাইয়ের পর থেকে সর্বোচ্চ।

মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর, ২০২৩ থেকে এ পর্যন্ত নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮,০২৬ জনে।

শনিবার রাফাহ শহরের কাছে একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালালে ২৭ জন নিহত হয় এবং আরও অনেকে আহত হয়। এই কেন্দ্রটি পরিচালনা করে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পাওয়া ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ)।

জিএইচএফ জানিয়েছে, তাদের সাইটে কোনো ঘটনা ঘটেনি। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীও তাদের সেনাদের গুলিতে কেউ হতাহত হয়নি বলে দাবি করেছে, তবে তারা বিষয়টি পর্যালোচনা করছে।

আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) জানিয়েছে, ওই এলাকার কাছে তাদের হাসপাতালে ১৩২ জন আহত রোগী এসেছে। তাদের মধ্যে ২৫ জনকে হাসপাতালে আনার পর মৃত ঘোষণা করা হয় এবং আরও ৬ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

মে মাস থেকে হাসপাতালটি চালু হওয়ার পর এটি ছিল মৃতের সর্বোচ্চ সংখ্যা।

আইসিআরসি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের উপর সহিংসতার মাত্রা বাড়ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসের শেষ থেকে ৭ জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় ত্রাণ বিতরণের সময় প্রায় ৮০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

গাজার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত আল-শাতি শরণার্থী শিবিরে শনিবার বিমান হামলায় ১৩ জন নিহত হয়। আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আবু সালমিয়া জানিয়েছেন, হামলায় আহত ৪০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

রবিবার সকালে, গাজার মধ্যাঞ্চলে নুসেইরাত শহরের কাছে একটি জল সরবরাহ কেন্দ্রের কাছে বিমান হামলায় ১০ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে ৬ জন শিশু ছিল। আল-আওদা হাসপাতাল জানিয়েছে, তারা ১৬ জন আহত ব্যক্তিকে গ্রহণ করেছে।

এছাড়াও, গাজা শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি জনাকীর্ণ স্থানে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ১১ জন নিহত হয় এবং ৫০ জনের বেশি আহত হয়।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তারা গাজার উত্তরে হামাসের ব্যবহৃত অস্ত্র ও সুড়ঙ্গ ধ্বংস করেছে। তারা আরও জানিয়েছে, বিমানবাহিনী গাজা উপত্যকা জুড়ে ১৫০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে ‘ফাঁদ পাতা ভবন, অস্ত্রের গুদাম, অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র এবং স্নাইপার অবস্থান’ ছিল।

গাজায় হতাহতের সংখ্যা যখন বাড়ছে, ঠিক তখনই দোহায় নতুন করে যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে দ্রুত কোনো সমাধানে আসার সম্ভাবনা কমে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ জানিয়েছেন, তিনি এই সপ্তাহের শেষ নাগাদ একটি চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। ট্রাম্প এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও সম্প্রতি হোয়াইট হাউসে গাজার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

কিন্তু দোহায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে কয়েক দিন ধরে আলোচনার পরেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে এখনো মতানৈক্য রয়েছে। একটি ইসরায়েলি সূত্র জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় কোথায় অবস্থান করবে, সেটিই প্রধান সমস্যা।

সর্বশেষ প্রস্তাব অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতির প্রথম দিনে উত্তর গাজা এবং সপ্তম দিনে দক্ষিণ গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করার কথা ছিল।

আলোচনা ‘ভেঙে গেছে’ উল্লেখ করে হামাসের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইসরায়েল নতুন শর্ত জুড়ে দিয়েছে। তাদের সর্বশেষ শর্ত হলো, গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর উপস্থিতির জন্য নতুন মানচিত্র তৈরি করতে হবে।

তবে ইসরায়েলের একটি রাজনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, ‘আলোচনায় নমনীয় হতে ইসরায়েল প্রস্তুত’, কিন্তু হামাস তাদের অবস্থানে অনড় রয়েছে।

নেতানিয়াহু রবিবার তার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের সঙ্গে বৈঠক করে আলোচনা নিয়ে আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে। বেন-গভির এবং অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচসহ নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার কট্টর ডানপন্থীরা হামাসের সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তির বিরোধিতা করছেন।

তারা গাজায় সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার এবং হামাসকে নির্মূল করার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

অন্যদিকে, ইসরায়েলে সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে, যুদ্ধ বন্ধ করে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার জন্য একটি চুক্তির প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে।

একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭৪ শতাংশ মানুষ মনে করে, ইসরায়েলের উচিত অবিলম্বে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা।

নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, প্রস্তাবিত ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির শেষে ইসরায়েলের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। অন্যদিকে, হামাস চাইছে, ইসরায়েলি বাহিনী সম্পূর্ণরূপে গাজা থেকে প্রত্যাহার করে নিলে অনির্দিষ্টকালের জন্য যুদ্ধ বন্ধ করা হোক।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *