গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় আহত শিশুদের আর্তনাদ: অঙ্গহানির পর কঠিন জীবন।
গাজা শহরের একটি ক্লিনিকে, ছোট্ট একটি পায়ে গোলাপী স্নিকার পরে, নতুন পায়ের সাহায্যে হাঁটা শেখার চেষ্টা করছিল পাঁচ বছর বয়সী সিলা আবু আকলান। প্রায় ১৫ মাস আগে ইসরায়েলি বিমান হামলায় মারাত্মকভাবে পুড়ে গিয়েছিল তার একটি পা।
অবশেষে, সে কৃত্রিম পা লাগানোর সুযোগ পেয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায়, শিশুদের অঙ্গহানির ঘটনা এক ভয়াবহ দৃশ্য। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সংস্থা ওচা (OCHA)-এর মতে, আধুনিক ইতিহাসে এত সংখ্যক শিশু অঙ্গ হারায়নি।
২০১৭ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে, আহত শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী ও সেবার তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। যুদ্ধবিরতির সময় কিছু সাহায্য সংস্থা কৃত্রিম অঙ্গ, হুইলচেয়ার ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করার চেষ্টা করলেও, তা চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ পূরণ করতে পেরেছিল।
কিন্তু পরিস্থিতি আবারও কঠিন হয়ে উঠেছে যখন ইসরায়েল খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য জরুরি সামগ্রীর প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরপর গত সপ্তাহে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান পুনরায় শুরু হওয়ায় হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে, যার ফলে অঙ্গ হারানো শিশুর সংখ্যাও বাড়ছে।
চিকিৎসা সহায়তার অভাবে, শিশুরা শুধু অঙ্গ হারানোর কষ্টই নয়, সেই সঙ্গে মানসিক আঘাতের শিকার হচ্ছে।
সিলা’র মা, বাবা ও দুই বোনকে একটি বিমান হামলায় হত্যা করা হয়। এরপর থেকেই তার ডান পায়ে মারাত্মক পোড়া ক্ষত সৃষ্টি হয়।
তার কাকা ইয়াসমিন আল-গফারি জানান, “আমি সবসময় চেষ্টা করি, কীভাবে সিলাকে খুশি রাখা যায়। কিন্তু সত্যি বলতে, এতে খুব বেশি কিছু করার থাকে না। ব্যথা তো সবসময় ব্যথাই, অঙ্গহানিও তো অঙ্গহানি।”
সিলা অন্য মেয়েদের খেলতে দেখে এবং তাদের মতো হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। সে প্রায়ই বলে, “আমি কেন এমন? আমি কেন তাদের মতো নই?”
১১ বছর বয়সী রিমের কথা ধরুন। অক্টোবর ২০২৩-এ, গাজা শহরে পরিবারের সাথে পালাতে গিয়ে একটি বিমান হামলায় সে তার হাত হারায়।
এখন সে নিজের জামাকাপড় পরতে পারে না, চুল আঁচড়াতে পারে না, এমনকি জুতোও বাঁধতে পারে না।
সাহায্য করার মতো কেউ না থাকলে সে রেগে যায় এবং ভাইবোনদের মারে। কখনও কখনও সে একা বসে থাকে, অন্য শিশুদের খেলা দেখে।
রিমে মা উম্মে রিম জানান, “একদিন রিমা তার বাবাকে বলেছিল, ‘আমি মরতে চাই’। আরেক দিন, আমরা যখন মাংসের কথা বলছিলাম, তখন সে হেসে বলেছিল, ‘আমাকে একটা ভেড়ার মতো জবাই করো’। ”
বিশেষজ্ঞদের মতে, নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ শিশু অঙ্গ হারিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১৭,৫০০ জন শিশু ও বয়স্ক গুরুতরভাবে আহত হয়ে পুনর্বাসন ও সহায়তার অপেক্ষায় রয়েছে।
যুদ্ধকালীন সময়ে, হাসপাতালগুলোতে এমন কিছু ঔষধের অভাব ছিল যা হয়তো অঙ্গহানি এড়াতে পারতো। অনেক ক্ষেত্রে, সংক্রমণের কারণে ডাক্তারদের অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়েছে, যা সহজেই চিকিৎসা করা যেত।
ইসরায়েল প্রায় প্রতিদিনই গাজার বাড়িঘর ও আশ্রয়কেন্দ্রে হামলা চালাচ্ছে, যেখানে পরিবারগুলো আশ্রয় নিয়েছিল।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সোমবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছে ১৫,০০০ এর বেশি শিশু, যাদের মধ্যে ৬ বছরের কম বয়সী প্রায় ৫,০০০ শিশুও রয়েছে।
এছাড়াও, ইসরায়েলের আক্রমণে ৫০,০০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১,১৩,০০০ জনের বেশি আহত হয়েছে।
গাজার প্রায় ২৩ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং বিশাল এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে।
গাজার উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে শিশুদের জীবন আরও কঠিন।
গত মে মাসে, মোয়াথ আব্দেলাল নামে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোর রাফাহ শহরে ইসরায়েলি বিমান হামলায় পা হারায়।
তার পরিবারকে একটি তাঁবুতে আশ্রয় নিতে হয়।
মোয়াথের বাবা হোসেন আব্দেলাল জানান, “ছেলের মানসিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।
ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ক্রাচে ভর করে হাঁটা তার জন্য কঠিন। এমনকি, তার পায়ের আরও কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়েছে।”
মানবিক সংস্থাগুলো কিছু পরিষেবা প্রদান করে।
সিলাকে গাজা সিটির ‘আর্টিফিসিয়াল লিম্বস অ্যান্ড পোলিও সেন্টার’-এ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এখানে শারীরিক থেরাপি, হুইলচেয়ার এবং কৃত্রিম অঙ্গ সরবরাহ করা হয়।
তবে, সরবরাহ সীমিত।
উত্তর গাজায় প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জন হুইলচেয়ারের জন্য আবেদন করে, জানিয়েছেন মেডিক্যাল এইড ফর প্যালেস্টাইন (MAP)-এর মাহমুদ শালাবি।
কিছু শিশুকে চিকিৎসার জন্য গাজা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তবে, স্থানান্তরের গতি খুবই কম, দিনে কয়েক ডজন এবং গত সপ্তাহে ইসরায়েলি হামলার পর তা আরও কমে গেছে।
আসমা আল-নাশাশ চান তার ১১ বছর বয়সী ছেলে আবদুর রহমান-কে বিদেশে পাঠিয়ে কৃত্রিম পা লাগাতে।
একটি উদ্বাস্তু শিবিরে বোমা হামলায় তার পায়ের কিছু অংশ উড়ে যায়।
এরপর থেকে, সে একাকী বসে মায়ের ফোনে গেম খেলে, কারণ সে অন্য শিশুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে পারে না।
অন্য শিশুরা তাকে ‘এক পায়ের ছেলে’ বলে ডাকে।
আসমা বলেন, “আমি যখন তাকে এমন দেখি, তখন আমার বুক ভেঙে যায়। আমি তার জন্য কিছুই করতে পারি না।”
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস।