গাজায় যুদ্ধ আর অবরোধের কারণে সেখানকার মানুষের জীবন এখন এক চরম সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে যেমন বোমারু বিমানের শব্দ, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন আর ধ্বংসস্তূপের মাঝে আটকে পড়া মানুষের আর্তনাদ, তেমনই আরেক আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের খালি হওয়ার শব্দ।
আগে যেখানে গ্যাসের মৃদু শিখা জানান দিতো গরম চায়ের কিংবা খাবারের আগমনী বার্তা, সেখানে এখন শুধুই শূন্যতার প্রতিধ্বনি।
রমজানের মাঝামাঝি সময়ে রান্নার গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার পর গাজার পরিবারগুলো কাঠ পোড়াতে শুরু করে। রাতের বেলা আগুন জ্বালালে ড্রোন হামলার শিকার হওয়ার ভয়ে তারা সেহ্রীর জন্য খাবার খেয়েছে ঠান্ডা, আর ইফতারের জন্য আগুন জ্বালিয়েছে।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে রুটি তৈরির জন্য স্থানীয় বেকারিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষজন খোলা জায়গায় বা তাঁবুর আশেপাশে চুলা তৈরি করে রুটি সেঁকতে শুরু করেছে।
চারিদিকে এখন ভারী, কালো ধোঁয়া – যা ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞের নয়, বরং ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া জীবনের ধোঁয়া। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তারা কাশে, যা সহজে থামে না।
এরপর পরিবারের সদস্যরা ধ্বংসস্তূপ থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে যায়। ভাঙা বাড়িঘর, পুরোনো আসবাবপত্র এমনকি স্কুলের ধ্বংসাবশেষ থেকেও তারা কাঠ সংগ্রহ করে।
কাঠ সংগ্রহ করা সহজ নয়। কাঠ ভাঙা, গুঁড়ো হওয়া কাঠ ও ধুলোবালির মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে হয় তাদের।
কাঠের দামও আকাশছোঁয়া। যুদ্ধের আগে যেখানে আট কেজি কাঠ পাওয়া যেত এক ডলারে, সেখানে এখন এক কেজি কাঠও পাওয়া যায় না সেই দামে।
দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই নিজেদের গাছের ডাল কাটতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি তাদের জলপাই গাছ, যা তারা ছোটবেলায় ছুঁতেও ভয় পেত, এখন সেই গাছের ডালপালাও কাটতে শুরু করেছে তারা।
যাদের গাছ নেই, তারা প্লাস্টিক, রাবার, এমনকি আবর্জনা পোড়াতে বাধ্য হচ্ছে। আর তা থেকে নির্গত হচ্ছে বিষাক্ত ধোঁয়া, যা তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসকে দূষিত করছে।
এই ধোঁয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট, দীর্ঘমেয়াদী রোগ এমনকি ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ হওয়ার সম্ভবনা বাড়ছে।
গ্যাস সংকটের কারণে পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়ে খাবার খাওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খাবারের আয়োজন এখন এক আতঙ্কের নাম।
এক সময়ের উষ্ণতা আর ভালোবাসার প্রতীক রান্নাঘর এখন বিষাক্ত এক স্থানে পরিণত হয়েছে। সেখানকার খাবারগুলোও যেন এখন স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ।
গ্যাস সংকটের কারণে খাদ্য সংকট তো আছেই, সেই সাথে পরিবারের ঐতিহ্য আর বন্ধনও ভেঙে যাচ্ছে। যেখানে একসময় একসাথে বসে খাবার খাওয়া হতো, সেখানে এখন অসুস্থতা আর উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটে।
একটা সময় ছিল যখন খাবার তৈরি মানে ছিল পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আনন্দ আর ভালোবাসার প্রকাশ, কিন্তু এখন তা যেন এক বিভীষিকা।
গাজায় আজ যারা বেঁচে আছে, তাদের বেঁচে থাকার অর্থ হলো বিষাক্ত ধোঁয়া গ্রহণ করে বেঁচে থাকা, সকালে এক কাপ চা খাওয়ার জন্য। গাজায় কাঠ এখন সোনার চেয়েও মূল্যবান।
সেখানে সাধারণ খাবার খাওয়াটাও এখন এক কঠিন লড়াই।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা