গাজায় পরিবারের সদস্যরা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, আর তিনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য লড়ছেন: এক ফিলিস্তিনি সাইক্লিস্টের অশ্রুসিক্ত সংগ্রাম।
ফিলিস্তিনের আলা আদ-দালি, যিনি একজন প্যারা-সাইক্লিস্ট, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন—প্যারা-সাইক্লিং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ।
কিন্তু এই সাফল্যের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে গাজায় তাঁর পরিবারের চরম দুর্দশা।
ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত গাজায় খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে তাঁর পরিবারের সদস্যরা অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
যুদ্ধের বিভীষিকা আর প্রিয়জন হারানোর শোকের মাঝেও, আদ-দালি কীভাবে নিজের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছেন, সেই গল্পই তুলে ধরা হলো।
আলা আদ-দালির সাইক্লিংয়ের প্রতি ভালোবাসা ছোটবেলা থেকেই।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিত্ব করতে চান।
কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য।
সম্প্রতি, তিনি এবং তাঁর সতীর্থ মোহাম্মদ আসফুর প্যারা-সাইক্লিং ওয়ার্ল্ড কাপে শীর্ষ ২০ জনের মধ্যে স্থান অর্জন করেন, যা তাঁদের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় জায়গা করে দিয়েছে।
কিন্তু গাজার পরিস্থিতি আদ-দালির জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ।
সেখানে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা অবরুদ্ধ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
হাসপাতালে অপুষ্টিতে শিশুদের মৃত্যুর খবর আসছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
সাহায্য পাঠানোর ওপর ইসরায়েলের বিধিনিষেধ পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
আমার পরিবার গাজায়।
আমার সন্তানেরা সেখানে।
এখন দুর্ভিক্ষ চলছে।
সেখানে গণহত্যা হচ্ছে।
আমরা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
আদ-দালি জানান, ইসরায়েলি হামলায় তিনি তাঁর ৩০ জনের বেশি বন্ধু ও আত্মীয়কে হারিয়েছেন।
তাঁর পরিবারের সদস্যরাও আহত হয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমার সন্তানেরা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, আর আমি অসহায়ের মতো তা স্ক্রিনে দেখছি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২১ মাসের বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় ৬০,০০০ জনের বেশি মানুষ নিহত এবং ১,৪৬,০০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
আদ-দালির এই পথচলা সহজ ছিল না।
২০১৮ সালে, তিনি এশিয়ান গেমসে ফিলিস্তিনের সাইক্লিং দলে জায়গা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন।
কিন্তু ‘গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন’ প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার সময় তিনি আহত হন এবং তাঁর একটি পা হারাতে হয়।
আদ-দালির ভাষায়, “আমি আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম।
মনে হয়েছিল, জীবন শেষ হয়ে গেছে।
অঙ্গহানি আমার জন্য অনেক বড় বিষয় ছিল।
কিন্তু তিনি হার মানেননি।
সাইক্লিংয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে, তিনি ধীরে ধীরে এক পায়ে সাইকেল চালানো শেখেন।
২০২০ সালে তিনি ‘গাজা সানবার্ডস’ নামে একটি প্যারা-সাইক্লিং দল গঠন করেন, যা শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য খাদ্য, আশ্রয় এবং আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করে।
এই পর্যন্ত, সানবার্ডস ৪,০০,০০০ মার্কিন ডলারেরও বেশি মূল্যের ত্রাণ বিতরণ করেছে।
আদ-দালি বলেন, “আমরা শুধু মানুষকে সাহায্য করছি না, বরং তাদের জীবনে একটু আলোর ঝলকানি দিচ্ছি।
গাজা সানবার্ডসের লন্ডন-ভিত্তিক সহ-প্রতিষ্ঠাতা করিম আলি গাজার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “যেখানে সাহায্যকর্মীরাই অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন, সেখানে একটি মৃতপ্রায় জনগোষ্ঠীর কাছে তাঁরা কীভাবে খাবার পৌঁছে দেবেন?
তিনি আরও বলেন, “আমাদের সবারই এই গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত।
আদ-দালি বর্তমানে বেলজিয়ামে আশ্রয় চেয়েছেন।
এই বছর তিনি এবং তাঁর দল ইউরোপ ও কাজাখস্তানে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য গাজা ত্যাগ করেন।
তিনি জানান, একজন ক্রীড়াবিদের মানসিক শান্তি ও বিশ্রাম অত্যন্ত জরুরি।
কিন্তু গাজার পরিস্থিতির কারণে তিনি সব সময় উদ্বিগ্ন থাকেন।
আদ-দালির দুঃস্বপ্ন আরও গভীর হয় যখন তিনি জানতে পারেন, তাঁর চাচাতো ভাই ও সানবার্ডস দলের সদস্য, আহমেদ আদ-দালি, ১৯ মে একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছেন।
আহমেদ ছিলেন তিন মেয়ের বাবা এবং সম্প্রতি তাঁর একটি পুত্রসন্তান জন্ম হয়।
তিনিও ২০১৪ সালে একটি পা হারান।
আদ-দালি বলেন, “আহমেদ একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন, যিনি সব সময় হাসতেন এবং আমাদের হাসাতেন।
তিনি আরও বলেন, “আমি আহমেদের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরব।
আলা আদ-দালি ও তাঁর সতীর্থ মোহাম্মদ আসফুর আগামী আগস্টে বেলজিয়ামে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেবেন।
আদ-দালি বলেন, “আমরা প্রমাণ করব যে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মানুষ তাদের জীবন চালিয়ে যেতে পারে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন