গাজায় দুর্ভিক্ষ: ইসরায়েল যদি অবরোধ না তোলে, তবে কী ঘটবে?

গাজায় মানবিক বিপর্যয়: ইসরায়েলের অবরোধ অব্যাহত থাকলে দুর্ভিক্ষের্র ঝুঁকিতে ফিলিস্তিনিরা।

গাজা উপত্যকায় খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, ইসরায়েল যদি সেখানকার অবরোধ শিথিল না করে, তাহলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের্র সম্মুখীন হতে পারে ফিলিস্তিনিরা। সেখানকার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে দুর্ভিক্ষ অনিবার্য হয়ে উঠবে। খবরটি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস।

খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় পাঁচ লক্ষ ফিলিস্তিনি বর্তমানে চরম খাদ্য সংকটে দিন কাটাচ্ছে এবং তাদের জীবন ঝুঁকির মুখে। এছাড়া, আরো প্রায় দশ লক্ষ মানুষ জরুরি খাদ্য সংকটের মধ্যে রয়েছে। ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গত দশ সপ্তাহ ধরে গাজায় খাদ্য, আশ্রয়, ঔষধপত্র কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।

একই সময়ে চলছে বিমান হামলা ও স্থল অভিযান। গাজার প্রায় ২৩ লক্ষ মানুষ বর্তমানে জীবন ধারণের জন্য বাইরের সাহায্যের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। কারণ, ইসরায়েলের ১৯ মাস ব্যাপী সামরিক অভিযানে সেখানকার খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে।

বর্তমানে গাজায় খাদ্য সরবরাহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সেখানকার কমিউনিটি রান্নাঘরগুলোই এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য একমাত্র খাবার সরবরাহ কেন্দ্র হিসাবে টিকে আছে, কিন্তু খাদ্য সংকটের কারণে সেগুলিও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

প্রতিদিন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি খাবার সংগ্রহের জন্য রান্নাঘরের বাইরে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। রিয়াম শেখ আল-ঈদ নামের একজন নারী জানান, “আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে থাকি। তারপরও অনেক সময় খাবার পাওয়া যায় না। সবার জন্য পর্যাপ্ত খাবার নেই।”

আন্তর্জাতিক সংকট বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক ক্রিস নিউটন মনে করেন, দুর্ভিক্ষ ঘোষণা না হলেও মানুষ যে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তার মতে, “হামাসকে নির্মূল করতে এবং গাজাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে সেখানকার মানুষকে অনাহারে রাখছে।”

এ বিষয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অফিসের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির সময় গাজায় পর্যাপ্ত সহায়তা প্রবেশ করেছে। তবে, ইসরায়েল বলছে, তারা চায় একটি নতুন ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে তারা সহায়তা বিতরণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

তাদের অভিযোগ, হামাস খাদ্য সহায়তা সরিয়ে নিচ্ছে।

জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। জাতিসংঘের মতে, ইসরায়েলের প্রস্তাবিত নতুন ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয় এবং এর মাধ্যমে মানবিক সহায়তা রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে।

এছাড়া, এটি ফিলিস্তিনিদের প্রয়োজনীয়তা মেটাতেও সক্ষম হবে না।

যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা একটি নতুন প্রক্রিয়া তৈরি করছে, যা দ্রুত ত্রাণ সরবরাহ শুরু করতে পারবে। তবে, তারা কোনো সময়সীমা জানায়নি।

জাতিসংঘ এখন পর্যন্ত এতে অংশ নিতে রাজি হয়নি, কারণ তাদের মতে, এই পরিকল্পনা মানবিক মানদণ্ড পূরণ করে না।

খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুদ্ধ, অবকাঠামোর ধ্বংস, কৃষি খাতের ক্ষতি এবং অবরোধের কারণে গাজার প্রায় সকল মানুষই বর্তমানে তীব্র খাদ্য সংকটের মধ্যে রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রধান বলেছেন, ত্রাণ সরবরাহ পুনরুদ্ধারে বিলম্ব হলে তা দুর্ভিক্ষের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, “যদি আমরা ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হই, তবে এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার, যা হলো খাদ্য পাওয়ার অধিকার, তা রক্ষা করতেও ব্যর্থ হবো।”

উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়, যাতে প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয়। এরপর ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করার ঘোষণা দেয় এবং গাজায় আক্রমণ জোরদার করে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় ইতিমধ্যে প্রায় ৫২,০০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু।

খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেইজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) -এর মতে, একটি এলাকাকে দুর্ভিক্ষ কবলিত ঘোষণা করার তিনটি মানদণ্ড রয়েছে।

  • প্রথমত, সেখানকার কমপক্ষে ২০ শতাংশ পরিবার চরম খাদ্য সংকটে ভুগবে।
  • দ্বিতীয়ত, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অন্তত ৩০ শতাংশ তীব্র অপুষ্টিতে ভুগবে।
  • তৃতীয়ত, প্রতিদিন প্রতি ১০,০০০ জনে অন্তত ২ জন বা পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪ জন শিশুর মৃত্যু হবে, যা অপুষ্টি এবং রোগের কারণে ঘটবে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গাজায় প্রথম মানদণ্ডটি পূরণ হয়েছে। বর্তমানে সেখানকার ২২ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ ৪,৭৭,০০০ জন “চরম খাদ্য সংকট”-এর মধ্যে রয়েছে।

এছাড়া, আরও ১ মিলিয়ন মানুষ জরুরি অবস্থার মধ্যে রয়েছে। যদিও অপুষ্টি এবং মৃত্যুর হার এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের অনাহারে মৃত্যুর জন্য সময় লাগে।

তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *