ফিরে এসে স্ত্রী-সন্তানদের খুঁজে না পাওয়া বাবার কান্না!

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার পর মুক্তি পাওয়া এক ব্যক্তির হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা।

গাজা শহরের একটি শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিলেন আলা আবু জেইদ। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি যখন নিজের বাড়িতে ফিরলেন, তখন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। আলার স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে হারিয়ে তিনি এখন সম্পূর্ণ একা।

গত বছরের এক ইসরায়েলি বিমান হামলায় তাদের মৃত্যু হয়। খবরটি জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম *দ্য গার্ডিয়ান*।

আলা আবু জেইদ খান ইউনিসে ফিরেই প্রথমে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন কেবল ভাই আলি। আলার স্ত্রী হালা, শিক্ষকতা করতেন, এবং তাঁদের পাঁচ সন্তান – তাঁদের সবারই মৃত্যু হয়েছে গত গ্রীষ্মে ইসরায়েলি বিমান হামলায়।

আলা আবু জেইদ গাজার বুরেইজ এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (UNRWA)-এর অর্থায়নে বিদ্যালয়টি পরিচালিত হতো। গত ডিসেম্বরে ইসরায়েলি সেনারা ওই বিদ্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বহু পুরুষকে আটক করে, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আলাও।

ভাই আলি জানান, পুরো সময়টা তাঁরা জানতেন না আলা কোথায় আছেন। তাঁরা তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পর আলা যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন তিনি যেন এক গভীর শোকের সাগরে ডুব দিলেন। আলিকে তিনি জানিয়েছিলেন, সন্তানদের সঙ্গে আবারও স্বাভাবিক জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখতেন তিনি।

কিন্তু এখন তাঁর সামনে কেবল ধ্বংসস্তূপ। ২০২৩ সালের ২০শে আগস্ট রাতে বুরেইজে তাঁদের বাড়িতে বিমান হামলা হয়। নিহত হন হালা, তাঁর মেয়ে প্রকৌশলী নওরা, ছেলে দন্তচিকিৎসা শিক্ষার্থী আলা, বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রিয়াদ, ১৫ বছর বয়সী ওয়ালা এবং ১৩ বছরের মোহাম্মদ।

আলি ও তাঁর ছেলেরা ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রিয়জনদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কেউই জীবিত ছিলেন না। মুসলিম রীতি অনুযায়ী, তাঁরা সেদিনই নিহতদের দাফন করেন।

স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে প্রায় ১,৪০০ পরিবারের সবাই নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এই হিসাবকে সঠিক বলে মনে করে।

জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি এবং বন্দী বিনিময়ের ফলে মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিরা যখন ঘরে ফিরতে শুরু করেন, তখন তাঁদের অনেকের জীবনে নেমে আসে গভীর শোক। প্রিয়জনদের খুঁজে বের করতে গিয়ে তাঁরা টের পান, কী বিশাল ক্ষতি হয়েছে তাঁদের।

আলা জানান, তিনি মুক্তি পাওয়ার পর তাঁদের কবরস্থানে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি কোনো কান্নাকাটি করেননি, সম্ভবত তিনি তখনও ছিলেন গভীর শোকে আচ্ছন্ন।

যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করা হয়। *দ্য গার্ডিয়ান*-এর অনুসন্ধানেও সেই চিত্র উঠে এসেছে। আলা আবু জেইদ নিজেও বন্দী অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

তাঁর চোখে গুরুতর আঘাত লাগে, যার জন্য অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। আলাকে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হতো না, ফলে তিনি ২৫ কেজি ওজন হারিয়েছিলেন। কারাগারের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত নোংরা এবং সেখানে চিকিৎসা পাওয়ারও কোনো সুযোগ ছিল না।

ফলে তাঁর শরীরে চর্মরোগ দেখা দেয়। আলা আবু জেইদ জানিয়েছেন, মুক্তি পাওয়ার পর তিনি যখন দেখলেন তাঁর পরিবারের কেউ নেই, তখন তিনি বুঝতে পারেন, কিছূ একটা মারাত্মক ভুল হয়েছে।

এখন তিনি আলি’র ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িতে থাকছেন এবং সুস্থ হয়ে উঠলে শিক্ষকতা পেশায় ফিরতে চান। তিনি এখন আগের চেয়ে অনেক শান্ত হয়ে গিয়েছেন এবং কারও সঙ্গে সহজে কথা বলতে পারেন না। তিনি বেশি সময় কাটান কোরআন পাঠ করে।

আলি জানিয়েছেন, আলা সবসময় তাঁর পরিবারকে কাছে পেতে চাইতেন, তাঁদের সঙ্গে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চাইতেন। কিন্তু এখন তাঁর জীবনে নেমে এসেছে এক ঘোর অমানিশা।

তথ্য সূত্র: *দ্য গার্ডিয়ান*

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *