গাজায় মানবিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট একটি সংস্থার ত্রাণ বিতরণের ঘোষণার মধ্যেই এর প্রধান পদত্যাগ করেছেন। গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামক এই সংস্থাটি জানিয়েছে, তারা অবরুদ্ধ গাজায় সরাসরি ত্রাণ বিতরণ শুরু করতে যাচ্ছে।
তবে এর কয়েক ঘণ্টা আগেই সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জেইক উড পদত্যাগ করেন। তিনি জানান, এই সংস্থার স্বাধীনতা নিয়ে তার গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে।
সোমবার এক বিবৃতিতে জিএইচএফ জানায়, তারা জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য, ওষুধ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণের পরিকল্পনা করছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর বাধার কারণে গত দুই মাস ধরে এসব ত্রাণ সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।
জিএইচএফের লক্ষ্য হলো, চলতি সপ্তাহের মধ্যে গাজার প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনিকে সহায়তা করা। পরবর্তীতে তারা দ্রুত এই কার্যক্রম আরও বড় পরিসরে নিয়ে যেতে চায়।
অন্যদিকে, ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা গাজায় ‘সামান্য’ ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দেবে। জাতিসংঘের পাশাপাশি অন্যান্য সাহায্য সংস্থাগুলো জিএইচএফের সঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়নি।
তাদের আশঙ্কা, এই সংস্থার কর্মপরিবেশ এবং ত্রাণ বিতরণের পদ্ধতি—যেমন, ফিলিস্তিনিদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে একত্র হওয়া—উভয়ই ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিদ্যমান ত্রাণ কার্যক্রমকে দুর্বল করে দেবে।
জেইক উড তার পদত্যাগের কারণ হিসেবে জিএইচএফের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এই সংস্থা মানবিক সহায়তা প্রদানের মূলনীতিগুলো—মানবিকতা, নিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীনতা এবং স্বাধীনতা—অবলম্বন করতে পারছে না।
তিনি ইসরায়েলকে আরও বেশি ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানান।
জিএইচএফের পরিচালনা পর্ষদ এক বিবৃতিতে উডের পদত্যাগে ‘হতাশা’ প্রকাশ করেছে, তবে গাজাজুড়ে ত্রাণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্রও জানিয়েছেন, তারা এই এনজিওকে সমর্থন করে।
জিএইচএফের কার্যক্রম এবং এর স্বাধীনতা নিয়ে ইতোমধ্যেই সমালোচনা শুরু হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবর অনুযায়ী, এই সংস্থাটি গঠিত হয়েছে ‘ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এমন কিছু সমমনা কর্মকর্তা, সামরিক কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত আলোচনার মাধ্যমে’। জাতিসংঘের পাশাপাশি প্রধান মানবিক সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে, জিএইচএফের কার্যক্রম বিদ্যমান ত্রাণ প্রচেষ্টাকে দুর্বল করতে পারে।
একইসঙ্গে এটি গাজার সীমিত কিছু এলাকার মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহ সীমাবদ্ধ করে দেবে, যার ফলে বেসামরিক নাগরিকদের ত্রাণ পাওয়ার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা চৌকি অতিক্রম করতে হতে পারে।
এছাড়াও, জিএইচএফের বিতরণ পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দাবি, এই পরিকল্পনা হামাসের নিয়ন্ত্রণ থেকে ত্রাণকে মুক্ত রাখতে তৈরি করা হয়েছে।
তবে অনেকের আশঙ্কা, এর মাধ্যমে ইসরায়েলের একটি উদ্দেশ্য—গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়া—সাধন করা যেতে পারে।
গাজায় মানবিক বিপর্যয় ক্রমেই বাড়ছে। সর্বশেষ খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদনে (আইপিসি) দেখা গেছে, গাজার প্রায় ১৯ লাখ ৫০ হাজার মানুষ—যা মোট জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ—গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
সাহায্য সংস্থাগুলো এই সংকটকে ‘মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ এনেছে।
নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ ওটাগোর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট প্যাটম্যান আল জাজিরাকে বলেছেন, জেইক উডের পদত্যাগ প্রমাণ করে যে প্রতিষ্ঠিত মানবিক সংস্থাগুলো জিএইচএফকে সমর্থন করছে না।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, অনেক মানবিক কর্মী মনে করেন, নতুন কোনো মানবিক সংস্থার প্রয়োজন নেই। বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত গাজার ওপর থেকে ইসরায়েলের অবরোধ তুলে নেওয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা