গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ: এক সপ্তাহের মধ্যে বন্ধ হতে পারে রুটি তৈরির কারখানা!

গাজায় খাদ্য সংকট: রুটির অভাবে বিপর্যয়ের শঙ্কা, অবরোধের মুখে দুই মিলিয়নের বেশি মানুষ।

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের অবরোধের কারণে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে গাজার বেকারিগুলোতে রুটি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় আটা ফুরিয়ে যাবে। খাবার ও অন্যান্য জরুরি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় সেখানকার প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের জীবন এখন সংকটাপন্ন। খবরটি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস।

গত চার সপ্তাহ ধরে ইসরায়েল গাজায় খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধসহ সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ গত ১৭ মাসের মধ্যে দীর্ঘতম অবরোধ। এতে সেখানকার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

জাতিসংঘের খাদ্য বিষয়ক সংস্থা জানিয়েছে, তাদের কাছে থাকা আটা দিয়ে আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত দৈনিক আট লাখ মানুষের জন্য রুটি তৈরি করা সম্ভব হবে। এছাড়া, তাদের খাদ্য সরবরাহও সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে। খাদ্য সরবরাহ দ্রুত স্বাভাবিক না হলে সেখানে মারাত্মক খাদ্য ও অপুষ্টির সংকট দেখা দেবে। কারণ, যুদ্ধের কারণে গাজায় স্থানীয় খাদ্য উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

গাজার জাবালিয়ায় জাতিসংঘের খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে খাবার নিতে আসা এক মা, শোরুক শামলাখ বলেন, “আমরা সম্পূর্ণভাবে এই সাহায্য-নির্ভর। এই সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে, আমাদের খাবার সরবরাহ করবে কে?”

খাদ্য সংকটের পাশাপাশি গাজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও আকাশছোঁয়া। বাজারে সবজির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে। কিছু পাওয়া গেলেও, তার দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এক কেজি পেঁয়াজের দাম ১৪ মার্কিন ডলার (১,৫০০ টাকার বেশি), টমেটোর দাম ৬ মার্কিন ডলার (৬৫০ টাকার বেশি)। রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ, ফলে সেখানকার বাসিন্দারা এখন জ্বালানির জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনালের গাজা বিষয়ক প্রধান ক্লিমেন্স লাগুয়ার্দাত বলেন, “আমাদের এমন কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যা সম্ভবত নেওয়া সম্ভব নয়। প্রত্যেকটি জিনিসেরই খুব প্রয়োজন।”

গত ১৮ মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান জোরদার করেছে, যার ফলে বহু ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। জাতিসংঘের তথ্যমতে, মানবিক সহায়তা কেন্দ্রগুলোতেও আঘাত হানা হয়েছে। নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি মানুষ।

এদিকে, ইসরায়েলের অবরোধের কারণে ত্রাণকর্মীদের কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ত্রাণকর্মীদের জন্য সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে চলাচলের যে ব্যবস্থা ছিল, সেটিও এখন স্থগিত রয়েছে। ফলে অনেক স্থানে খাবার সরবরাহ, অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের জন্য পুষ্টি কর্মসূচি এবং অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

অন্যদিকে, ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, গাজায় অবরোধের মূল উদ্দেশ্য হলো হামাসকে অস্ত্র বিরতির শর্তগুলো পরিবর্তনে রাজি করানো এবং জিম্মিদের মুক্তি দিতে বাধ্য করা। তবে অবরোধ তুলে নেওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানাননি।

গাজায় খাদ্য বিতরণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে ইউএনআরওয়া জানিয়েছে, তাদের কাছে আর কয়েক হাজার ফুড পার্সেল এবং কয়েক দিনের মতো আটা মজুদ আছে। গাজা স্যুপ কিচেন-এর প্রতিষ্ঠাতা হানি আলমাদাউন জানান, খাদ্য সংকটের কারণে অনেক বেশি মানুষ সাহায্যের জন্য আসছেন এবং খাবারের জন্য তাদের মধ্যে প্রায়ই মারামারি হচ্ছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার মুখপাত্র ওলগা চেরেভকো জানান, খাদ্য বিতরণের পরিমাণ কমিয়ে রুটি তৈরি ও প্রস্তুতকৃত খাবারের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিদিন ৯ লাখ ৪০ হাজার মানুষের জন্য খাবার তৈরি করা হচ্ছে, যা আগে থেকে ২৫ শতাংশ বেশি।

গাজায় কর্মরত আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের জন্য তাদের পুষ্টি বিষয়ক কার্যক্রমও বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। কারণ, তাদের কর্মীরা ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছেন না।

সব মিলিয়ে গাজার পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। খাদ্য ও ঔষধের অভাবে সেখানকার মানুষের জীবন চরম হুমকির মুখে।

তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *