গাজায় ইসরায়েলের অবরোধের কারণে মানবিক বিপর্যয়, খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে অসহায় ফিলিস্তিনিরা। গাজায় ইসরায়েলি অবরোধের কারণে সেখানকার পরিস্থিতি চরম মানবিক সংকটে পৌঁছেছে।
সেখানকার সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক এবং ত্রাণকর্মীরা জানিয়েছেন, গত সাত সপ্তাহ ধরে চলা অবরোধের ফলে গাজায় জরুরি সহায়তা পাঠানো যাচ্ছে না। এর ফলে খাদ্য, জ্বালানি ও চিকিৎসা সামগ্রীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
গাজার বাসিন্দারা নতুন করে স্থানান্তরের নির্দেশনার পাশাপাশি হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বোমা হামলার শিকার হচ্ছেন। খবর অনুযায়ী, সেখানকার পরিস্থিতি যুদ্ধের শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
গত ২ মার্চ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেয় ইসরায়েল। এরপরই তারা গাজায় সব ধরনের সহায়তা বন্ধ করে দেয়।
দুই সপ্তাহের বেশি সময় পর তারা ব্যাপক বোমা হামলা চালানো শুরু করে এবং স্থল সৈন্যও পুনরায় মোতায়েন করে।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বারবার বলছেন, হামাস অবরুদ্ধ করে রাখা জিম্মিদের মুক্তি না দিলে সহায়তা কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হবে না। ইসরায়েলি সরকার এই অবরোধকে একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং তারা খাদ্যকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
অবরোধ ইতিমধ্যে আট সপ্তাহে পড়েছে, যা ১৮ মাসের যুদ্ধে গাজার জন্য সবচেয়ে দীর্ঘকালীন অবরোধ। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট ইসরায়েল মনে করছে, আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে তারা এই অবরোধ চালিয়ে যেতে পারবে।
গাজায় ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখলের পাশাপাশি ইসরায়েল নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করছে। এছাড়াও, ত্রাণ বিতরণ সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে গাজাবাসীর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে সেখানে ইসরায়েলি সেনা উপস্থিতি এবং তাদের বিতাড়িত করার আশঙ্কা বাড়ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলার সময় অনেকে জানিয়েছেন, তারা বোমা হামলার চেয়ে দুর্ভিক্ষের ভয়ে বেশি ভীত। গাজার উত্তরাঞ্চলের বাইত লাহিয়ার ৪৪ বছর বয়সী শিক্ষক হিকমত আল-মাসরি জানান, ‘খাদ্যের অভাবে ছেলেকে খাবার দিতে গিয়ে অনেক সময় নিজের ভাগের খাবার ছেড়ে দিতে হয়েছে।
ধীরে ধীরে ক্ষুধার জ্বালায় মরে যাওয়াটাই আমার কাছে সবচেয়ে কষ্টের।’
দুই মাসের যুদ্ধবিরতির সময় মজুদ করা খাবার শেষ হয়ে যাওয়ায় সেখানকার মানুষজন খাবার সংগ্রহের জন্য দাতব্য সংস্থার রান্নাঘরের সামনে ভিড় করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সেখানকার বাজারে খাবারের দাম যুদ্ধবিরতির সময়ের তুলনায় ১,৪০০ শতাংশ বেড়েছে।
নতুন করে ইসরায়েলের স্থানান্তরের নির্দেশনার কারণে প্রায় ৪ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ফলে সেখানকার খাদ্য ও অপুষ্টির সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে অক্সফামের ধারণা, বর্তমানে অধিকাংশ শিশু দিনে এক বেলা খাবারের চেয়েও কম খাচ্ছে।
প্রায় ৯৫ শতাংশ ত্রাণ সংস্থা বোমা হামলা ও অবরোধের কারণে তাদের কার্যক্রম হয় স্থগিত করেছে, নয়তো কমিয়ে দিয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক কর্মীদের গাজায় প্রবেশের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
এমনকি ব্যথানাশক ওষুধসহ জরুরি চিকিৎসা সামগ্রীরও অভাব দেখা দিয়েছে।
গাজা শহরের জরুরি সমন্বয়কারী আমান্দে বাজারোল বলেন, ‘ইসরায়েলি সেনারা উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়ায় সেখানে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তারা হয় রাস্তায় বসবাস করছে, না হয় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে।
সেখানে এত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। আমাদের বার্ন ক্লিনিকে প্রতিদিন সকাল ১০টার মধ্যে রোগীদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে, কারণ আমাদের ওষুধ সরবরাহ সীমিত।’
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ এখন ইসরায়েলি সেনা অভিযানের আওতায় রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য মানবিক সহায়তা পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
ত্রাণকর্মীরা বলছেন, যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর নিয়মকানুন পরিবর্তন হয়েছে। খান ইউনিসের নাসের হাসপাতাল এবং গাজা শহরের আল-আহলি হাসপাতালে বোমা হামলার ঘটনা এর প্রমাণ।
নাসের হাসপাতালে হামলায় আন্তর্জাতিক মেডিকেল টিমের সদস্যরা আহত হয়েছেন। আল-আহলি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এবং অস্ত্রোপচার বিভাগ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) জানিয়েছে, তারা হামাস জঙ্গিদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ত্রাণকর্মী বলেন, ‘গাজার মানুষজন মনে করে, আন্তর্জাতিক কর্মীরা সেখানে থাকলে তাদের সুরক্ষা বাড়বে এবং ইসরায়েলি সেনারা সহজে হামলা করবে না।
যুদ্ধের শুরুতে আমাদের অবস্থান থেকে ২ কিলোমিটার দূরে বোমা হামলা হলে আমরা সরে যেতাম। এখন সেটি ৩০০ মিটার, এমনকি ৩০ মিটারের মধ্যেও চলে এসেছে।
হয় কোনো সতর্কবার্তা পাওয়া যায় না, অথবা পাওয়া গেলেও তা অসুস্থ রোগীদের সরানোর জন্য যথেষ্ট সময় দেয় না। আমরা এখন অনেক বেশি ঝুঁকিতে আছি।
আমরা জানি, ইসরায়েলিরা তাদের শর্তে কাজ করতে বাধ্য করতে চাইছে।’
আইডিএফের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় হামাসের কার্যক্রম চালানোর প্রমাণ রয়েছে। সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা আন্তর্জাতিক আইনের বিধান মেনেই করা হয়।’
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এড়িয়ে বেসরকারি ঠিকাদারদের মাধ্যমে গাজায় মানবিক সহায়তা বিতরণের একটি পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
তবে এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং কবে নাগাদ এটি বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে কোনো সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি। ত্রাণ সংস্থাগুলোর মতে, এই পরিস্থিতিতে মানবিক সংকট আরও বাড়বে।
আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীরা যুদ্ধবিরতি আলোচনা পুনরায় শুরু করার চেষ্টা করছেন, তবে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান