গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় গুরুতর আহত ১৫ বছর বয়সী মাজদ আলশাগনবীর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ফিলিস্তিনের এই কিশোরের জীবন বাঁচানোর লড়াই এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা নতুন করে সামনে এনেছে শিশুদের প্রতি হওয়া নৃশংসতাকে।
গত ফেব্রুয়ারিতে গাজার উত্তরাঞ্চলে রুটির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ইসরায়েলি হামলায় গুরুতর জখম হয় মাজদ। তার চোয়াল ও মুখের নিচের অংশে গুরুতর আঘাত লাগে।
মাজদ জানায়, “আহত হওয়ার পর প্রথমে সবাই আমাকে মৃত ভেবেছিল এবং মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আমি হাত নাড়াচাড়া করি, তখন আমার দেহে প্রাণের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।”
গাজার আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালে পর্যাপ্ত অপারেশন থিয়েটার না থাকায় আহত মাজদের অস্ত্রোপচার হয় একটি রান্নাঘরে। এরপর ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হেঁটে কোনোমতে খান ইউনিসে মা’র কাছে ফেরে সে। সেখানকার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে মাজদ জানায়, “তখন খুব ভয় লাগছিল, কারণ সেখানে ইসরায়েলি সেনারা ছিল।”
পরে, একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়। সেখানে তার মুখের অস্ত্রোপচার হয়েছে। তবে মাজদের এই চিকিৎসা গাজায় শিশুদের জন্য চলমান মানবিক সংকটের তুলনায় খুবই সামান্য, এমনটাই মনে করেন অনেকে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ-এর মতে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ইতিমধ্যে ৫০,০০০ এর বেশি শিশু হতাহত হয়েছে।
জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থার প্রধান ফিলিপ লাজ্জারিনি জানিয়েছেন, গাজায় শিশুদের অঙ্গহানির ঘটনা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ৭ই অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে হামাস-এর হামলার পর থেকে গাজায় বোমা হামলা ও অবরোধের কারণে সেখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসা সহায়তা চেয়ে অপেক্ষারত অবস্থায় ইতোমধ্যে ৭০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন, যাদের মধ্যে প্রায় ১৪০ জন শিশু রয়েছে।
চিকিৎসা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (MSF) জানায়, অক্টোবর ২০২৩ থেকে জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত ৭,৬৪২ জন রোগীকে গাজা থেকে চিকিৎসার জন্য অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫,৩০৩ জনই ছিল শিশু। তবে, এই রোগীদের মধ্যে মাত্র ০.০৩% যুক্তরাজ্যে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
প্রজেক্ট পিওর হোপ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ওমর দিন বলেন, “গাজায় শিশুদের স্বাস্থ্য বিষয়ক সংকট অনেক। অনেক শিশু তাদের হাত-পা হারিয়েছে, খাবার খেতে পারছে না। আমরা যদি আন্তরিক হই, তবে আরও অনেক কিছু করতে পারি। এই মানুষগুলোরও ভালো চিকিৎসার অধিকার আছে।”
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় শিশুদের দুর্দশার কথা তুলে ধরে সেখানকার চিকিৎসক, অভিভাবক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা জানিয়েছে, সেখানকার শিশুরা বর্তমানে চরম ক্ষুধা, আতঙ্ক ও বোমা হামলার শিকার হচ্ছে। এমএসএফ-এর ভাষ্যমতে, অনেকে তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য মৃত্যুকে কামনা করছে।
মাজদের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নিউরোসার্জন ড. ওওয়াস জিলানি বলেন, “মাজদের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যদি আমরা ভালো ফল পাই, তবে ভবিষ্যতে আরও শিশুদের চিকিৎসার পথ খুলবে।”
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ড. মুনির আল-বুরশ জানান, গত ৭ই অক্টোবর থেকে ইসরায়েল গাজার ৩৮টি হাসপাতালকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত ১,৭২৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন।
বর্তমানে মাজদ লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার মা ইসলাম ফেলফেল জানান, তিনি চান গাজা আবার আগের রূপে ফিরে আসুক, সবাই একসঙ্গে থাকুক। তিনি বলেন, “আমি যদি জানতাম যুদ্ধ আবার শুরু হবে, তাহলে আমি আমার ছেলেদের (মুহাম্মদ ও ইউসুফ) ছেড়ে আসতাম না। তারা আমাকে বলছে, ‘তুমি আমাদের একা ফেলে এসেছ। তুমি তোমার প্রিয় ছেলেকে নিয়ে এসেছ, আর আমরা এখানে মরে যেতে পারি।”
বর্তমানে মাজদের দুই ভাই গাজায় তাদের বাবার সঙ্গে আছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক হামলায় গাজা শহরের তিনটি হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এখন পর্যন্ত শহরটি থেকে ৩,২০,০০০ এর বেশি মানুষকে অন্যত্র যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন