গাজায় আটক ফিলিস্তিনিদের স্বজন হারানোর খবর জানানো হয়নি: আন্তর্জাতিক সংবাদ।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক হওয়া ফিলিস্তিনিদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা জানা গেছে। মুক্তির পর তারা জানতে পারেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন। কিন্তু বন্দী থাকা অবস্থায় তাদের এই খবর জানানো হয়নি।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে এমনটাই জানা যায়।
আহমেদ ওয়ায়েল দাবাবিশ নামের এক ফিলিস্তিনি জানান, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইসরায়েলি সেনারা একটি স্কুলে আশ্রয় নেওয়া তার পরিবারের ওপর হামলা চালায়। সেনাদের নির্দেশে পুরুষদের বাইরে আনা হয় এবং তাদের মধ্যে দাবাবিশসহ অনেককে আটক করা হয়।
এরপর ১৩ মাস ধরে কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাকে বন্দী করে রাখা হয়। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো সুযোগ ছিল না। যখন জানা গেল, ইসরায়েলি গোলার আঘাতে দাবাবিশের স্ত্রী আসমা ও তাদের তিন বছর বয়সী মেয়ে ঘিনা নিহত হয়েছে, তখন খবরটি জানানোর কোনো উপায় ছিল না।
কারাগারে ৩৩ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যুদ্ধবিরতির কারণে ফেব্রুয়ারিতে তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর যখন তিনি তার বাবাকে দেখেন, তখন যেনো ভাষা হারিয়ে ফেলেন। তার পরিচিত মুখগুলোর মাঝে ফিরে আসার আনন্দ স্থায়ী হয়েছিল, যতক্ষণ না তিনি তার স্ত্রী ও মেয়ের কথা জানতে পারেন।
দাবাবিশের বাবা তার ফোনে একটি ছবি দেখান, যেখানে ঘিনার মরদেহ তার এক আত্মীয়ের পাশে দাফনের জন্য রাখা হয়েছে। “আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না,” কান্নায় ভেঙে পড়েন দাবাবিশ। “আমি স্বপ্নেও ভাবিনি তারা মারা যেতে পারে।”
দাবাবিশের দুই সন্তান, ছয় বছর বয়সী মুয়াজ এবং আট বছর বয়সী আয়েশা, বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে।
দাবাবিশের মতো একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে আরও অনেকের সঙ্গে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানায়, গাজা থেকে আসা আরও তিনজন ফিলিস্তিনি তাদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন, যখন তারা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বা বেসামরিক কারাগারে বন্দী ছিলেন।
মুক্তির পর তারা তাদের স্বজন হারানোর খবর জানতে পারেন।
আটক হওয়া এই তিন ব্যক্তি হলেন একজন নার্স, একজন সরকারি কর্মচারী এবং একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তারা জানিয়েছেন, তারা কোনো অস্ত্র ব্যবহার করেননি। তাদের আইনজীবী পাওয়ার সুযোগ ছিল না এবং পরিবারের সঙ্গেও কথা বলতে দেওয়া হয়নি।
আইন সংস্থাগুলোর মতে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় স্বজন হারানো আরও অনেক বন্দী আছেন, যাদের এই দুঃসংবাদ জানানো হয়নি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর থেকে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে পরিবার পরিজনের সাক্ষাৎ, চিঠি দেওয়া বা ফোনের মাধ্যমে কথা বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এমনকি তাদের সেল থেকে টেলিভিশন ও রেডিওও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ফিলিস্তিনি বন্দীদের অধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘আদ্দামির’-এর তালা নাসির জানান, “তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বন্দীদের বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তারা চায় না বন্দীরা তাদের পরিবার এবং প্রিয়জনদের সম্পর্কে কোনো খবর জানুক।”
যেসব বন্দীর আইনজীবী পাওয়ার সুযোগ আছে, তারা হয়তো আইনজীবীর মাধ্যমে কিছু খবর পান। কিন্তু গাজার শত শত, এমনকি সম্ভবত হাজার হাজার বন্দী আছেন, যাদের কোনো আইনজীবী নেই।
ইসরায়েলের ‘আনলফুল কমব্যাটেন্টস ল’-এর অধীনে অনেককে আটক রাখা হয়েছে, যেখানে কোনো প্রমাণ ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখার সুযোগ রয়েছে।
কোনো ব্যক্তিকে আইনজীবী পাওয়ার সুযোগ দেওয়ার আগে বা বিচারের জন্য আদালতে তোলার আগে ৪৫ দিন পর্যন্ত আটকে রাখা যায়। যুদ্ধের শুরুতে এই সময়সীমা ১৮০ দিন এবং ৭৫ দিন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, এই ব্যবস্থা “যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আটক রাখা, গুম করা এবং বিচারহীনতার সুযোগ তৈরি করে। এটি বাতিল করা উচিত।” ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর গাজায় আটক হওয়া কারো বিচার হয়েছে এমন খবর পাওয়া যায়নি।
ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি বন্দীদের জন্য সরকারিভাবে কোনো আইনজীবী নিয়োগ করা হয় না। সেখানকার মানবাধিকার সংস্থা ‘হামোকেদ’-এর নির্বাহী পরিচালক জেসিকা মন্টেল বলেন, “আমি নিশ্চিত যে, গাজায় আটক হওয়া অধিকাংশ বন্দীই কোনো আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। তাদের জন্য কোনো সরকারি আইনজীবীও নেই।”
বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতা এবং বন্দী শিবিরগুলোর দূরত্বের কারণে আইনজীবীদের সেখানে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। নাসির জানান, যখন আইনজীবীরা গাজা থেকে আসা বন্দীদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন, তখন তাদের কষ্টের খবর শোনানো কঠিন হয়ে পড়ে।
ডিসেম্বরে ইসরায়েল জানায়, তারা ‘আনলফুল কমব্যাটেন্টস ল’-এর অধীনে গাজা থেকে আসা ৩,৪০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে আটক করে রেখেছে।
যুদ্ধবিরতির সময় গাজা থেকে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন ইব্রাহিম দাউদ। তিনি জানান, তার কোনো আইনজীবী ছিল না এবং তিনি যখন নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে চান, তখন তাকে মারধর করা হয়। তিনি ১৩ মাস নেগেভ মরুভূমির কারাগারে ছিলেন। সেখানে ইসরায়েলি হামলায় আহত হয়ে তিনি এসেছিলেন।
শারীরিক অসুস্থতা, ক্ষুধা এবং মারধরের চেয়েও খারাপ ছিল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার মানসিক যন্ত্রণা। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন, আল-ফাকুরার একটি বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার বাবা, বোন, বোন-জামাই এবং তার তিন সন্তান নিহত হয়েছে।
ইসরায়েল প্রিজন সার্ভিস (আইপিএস) জানিয়েছে, “আইন অনুযায়ী সকল বন্দীকে আটক করা হয়েছে।”
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজা থেকে কতজন ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে, অথবা কতজন আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে পেরেছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানায়নি।
তবে তারা জানিয়েছে, আইনজীবীদের সঙ্গে বন্দীদের আলোচনার বিষয়বস্তু বা আইনজীবীদের আনা নথিপত্রের ওপর কোনো বিধিনিষেধ নেই। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরও জানায়, তারা বন্দীদের সঙ্গে আচরণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে এবং নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে।
তথ্য সূত্র: আন্তর্জাতিক সংবাদ।