গাজায় ধ্বংসস্তূপের মাঝেও বাঁচার লড়াই: এক নারীর অশ্রুসিক্ত আত্মকথা

গাজায় বেঁচে থাকার লড়াই: ধ্বংসস্তূপের মাঝেও শিক্ষার আলো

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় জীবন এক দুঃস্বপ্নের মতো। প্রতিদিনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন মৃত্যুর হাতছানি। ঘরবাড়ি, প্রিয়জন হারানোর শোক বুকে নিয়ে, সামান্য আশ্রয়ের সন্ধানে আজও লড়ছে সেখানকার মানুষ।

সম্প্রতি আল জাজিরায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে গাজার এক তরুণীর জীবনের মর্মান্তিক কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। কিভাবে তিনি এত প্রতিকূলতার মাঝেও টিকে আছেন, সেই গল্প শুনলে পাথরও গলে যায়।

যুদ্ধ শুরুর আগে, ওই তরুণীর জীবনটা ছিল আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই। ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল করে লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। কিন্তু গাজার অস্থির পরিস্থিতি আর অবিরাম বোমা হামলার কারণে সবসময় একটা অনিশ্চয়তা কাজ করত।

যুদ্ধ সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়। তার ঘর, বিশ্ববিদ্যালয়, বন্ধু-বান্ধব, এমনকি স্বাস্থ্য—সবকিছুই যেন চোখের পলকে হারিয়ে যায়।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে প্রথম “সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ” আসে। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে, অল্প কিছু জিনিস নিয়ে ঘর ছাড়তে হয় তাদের। এরপর শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ।

বোমার শব্দ, চিৎকার আর কান্নার রোল—যেন কেয়ামতের বিভীষিকা নেমে এসেছে। আশ্রয়হীন অবস্থায় তারা একটি উদ্বাস্তু শিবিরে যান। সেখানে চরম অভাবের মধ্যে দিন কাটাতে হয়—খাবার নেই, জল নেই, শীতের কাপড় নেই।

এরই মধ্যে খবর আসে, তাদের বাড়ি বোমা হামলায় উড়ে গেছে। বাবার সোনার দোকানটিও মাটির সঙ্গে মিশে যায়। শোকের এই কঠিন সময়ে, সবচেয়ে কাছের বন্ধু রামাহ’র মৃত্যুর খবর আসে।

শোক তখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি, এর মধ্যেই বাবার পরিবারের সবাই—আত্মীয়-স্বজন, তাদের স্ত্রী ও সন্তানসহ—একসঙ্গে নিহত হন।

এরপর আসে জুন মাসের ৮ তারিখ। তারা একটি ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে উঠেই নতুন করে জীবন শুরু করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ইসরায়েলি সেনারা এলাকাটি ঘিরে ফেলে।

এরপর যা ঘটল, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় গুরুতর আহত হন ওই তরুণী। জ্ঞান হারাবার আগে শুধু ‘শাহাদা’ পাঠ করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি।

হাসপাতালে দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা চলে। মাথায়, হাতে, পায়ে এবং পিঠে গুরুতর আঘাত ছিল। অস্ত্রোপচার হয়, কিন্তু ক্ষতগুলো আজও শরীরে লেগে আছে। হাসপাতালের প্রতিটি দিন ছিল এক কঠিন পরীক্ষা।

শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি মানসিক অবসাদও গ্রাস করে তাকে। বেঁচে থাকার ইচ্ছাই যেন হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই গভীর হতাশার মধ্যেও তিনি হাল ছাড়েননি।

ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকেন। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাকে আবারও আলোর পথে ফিরিয়ে আনে। অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হলে, ভাঙা হাত নিয়েই তিনি পরীক্ষায় বসেন। মা পাশে থেকে সাহায্য করতেন।

আজও তারা উদ্বাস্তু শিবিরে দিন কাটাচ্ছেন। খাবার আর বিশুদ্ধ পানির জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়। দুর্ভিক্ষের এই সময়ে, প্রিয়জন হারানোর বেদনা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাওয়া সহজ নয়।

কিন্তু ওই তরুণী প্রমাণ করেছেন, মানুষ চাইলে সব পারে। তিনি ধ্বংসস্তূপের মাঝেও খুঁজে পেয়েছেন বাঁচার পথ।

যুদ্ধ তার শরীর ও মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে, কিন্তু একইসঙ্গে দিয়েছে অদম্য সাহস। তিনি শোককে জয় করে, নতুন করে বাঁচতে শিখেছেন।

লেখিকা হিসেবে, তিনি চান, বিশ্ববাসী গাজার মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা জানুক। কারণ, তিনিও বাঁচতে চান, আর পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মতোই তারও বাঁচার অধিকার আছে।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *