ফোরম্যানের পতাকা: কেন সেটি আজও বিতর্কের জন্ম দেয়?

খেলাধুলা এবং রাজনীতির প্রেক্ষাপটে জর্জ ফোরম্যান: ১৯৬৮ সালের অলিম্পিক থেকে এক নতুন যাত্রা।

১৯৬৮ সালের মেক্সিকো সিটি অলিম্পিকে বক্সিংয়ের মঞ্চে যখন টেক্সাসের এক তরুণ, জর্জ ফোরম্যান, আমেরিকার পতাকা হাতে স্বর্ণপদক জয় করে হাসিমুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন হয়তো তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি তার এই আনন্দ উদযাপন কতটা রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেবে। সেই সময়ে, যখন আমেরিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে, এই দৃশ্যটি অনেকের কাছেই ভিন্ন বার্তা নিয়ে এসেছিল।

ঠিক দু’দিন আগেই, একই অলিম্পিকে, টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস নামক দুই কৃষ্ণাঙ্গ দৌড়বিদ, আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময় মাথা নিচু করে, কালো গ্লাভস পরিহিত মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তাদের এই নীরব প্রতিবাদ ছিল আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ সমাজের বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদ। তাদের এই পদক্ষেপ সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে, যা ইতিহাসের পাতায় গেঁথে আছে। তাদের প্রতিবাদ ছিল সরাসরি, সুস্পষ্ট। অন্যদিকে, ফোরম্যানের পতাকা উত্তোলন অনেকের কাছে মনে হয়েছিল, যেন সেই অবিচারের প্রতি সমর্থন।

ফোরম্যানের এই পতাকা প্রদর্শন অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। বিশেষ করে, ‘ব্ল্যাক পাওয়ার’ আন্দোলনের সমর্থকেরা এই বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। তাদের মতে, একজন কৃষ্ণাঙ্গ হয়ে কীভাবে ফোরম্যান এমন একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন, যে দেশটিতে এখনো তাদের অধিকার পুরোপুরিভাবে স্বীকৃত নয়? তাদের প্রতিবাদের ভাষা ছিল আরও কঠিন, আরও স্পষ্ট। ১৯৬৮ সালের অস্থির সময়ে, যখন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে হত্যা করা হয়েছে, ‘ব্ল্যাক পাওয়ার’ একটি শক্তিশালী শব্দে পরিণত হয়েছে, তখন ফোরম্যানের এই আচরণ অনেকের কাছে দ্বিধা তৈরি করে।

স্মিথ ও কার্লোসের প্রতিবাদ ছিল সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য তাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। অলিম্পিক থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল তাদের, এমনকি দীর্ঘ সময় ধরে পেশাদার বক্সিং থেকেও দূরে থাকতে হয় তাদের। তাদের এই ত্যাগ আজও স্মরণীয়। কিন্তু সেই সময়ে, ফোরম্যানের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাদের মতে, প্রতিবাদ জানানোর একটি নির্দিষ্ট ধরন থাকতে হবে। ফোরম্যান যেন সেই নিয়ম ভেঙেছিলেন।

ফোরম্যান অবশ্য সবসময় বলেছেন, পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে তিনি কোনো বার্তা দিতে চাননি। তিনি শুধু জয় উদযাপন করতে চেয়েছেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালে, আনন্দ প্রকাশ করাটাও ছিল রাজনৈতিক। সেই সময়ে, যখন শিকাগোতে ট্যাংক নামানো হয়েছিল, যখন কিংয়ের হত্যার শোক এখনো কাটেনি, তখন আমেরিকার পতাকা ওড়ানো ছিল একটি জটিল বিষয়।

শ্বেতাঙ্গ মিডিয়া ফোরম্যানকে ‘ভালো’ কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় হিসেবে তুলে ধরেছিল, যা স্মিথ ও কার্লোসের সঙ্গে তার পার্থক্য আরও বাড়িয়ে দেয়। ফোরম্যানকে যেন দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল, যা প্রতিবাদকারীদের ঠিক বিপরীত ছিল।

কিন্তু ফোরম্যানের জীবন এত সরল ছিল না। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন দরিদ্র পরিবারে, টেক্সাসের একটি কঠিন এবং পৃথকীকৃত অঞ্চলে। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে তিনি বক্সিংকে বেছে নেন। তার কাছে পতাকা ছিল এমন একটি দেশের প্রতীক, যা তাকে নতুন একটি পথ দেখিয়েছিল। তার দেশপ্রেম ছিল গভীর ব্যক্তিগত।

সমালোচকেরা ফোরম্যানকে ‘আংকেল টম’ বলে অভিযুক্ত করেছিলেন। শ্বেতাঙ্গ সমাজের কাছে আত্মসমর্পণ করার অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে। এই সমালোচনার কারণে তিনি অনেকের কাছে অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েন। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি অনেকটা গুটিয়ে যান।

রিংয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভয়ঙ্কর, প্রতিশোধপরায়ণ। ১৯৭৩ সালে জো ফ্রেজিয়ারকে পরাজিত করে যখন তিনি হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন, তখন তার মধ্যে আনন্দের বদলে দেখা গিয়েছিল এক ধরনের দৃঢ়তা। পরাজয়ের পর, ফোরম্যান এক দশক বক্সিং থেকে দূরে ছিলেন। এরপর তিনি ধর্ম গ্রহণ করেন এবং একটি যুব কেন্দ্র খোলেন।

১৯৮০-এর দশকে যখন তিনি আবার ফিরে আসেন, তখন তার মধ্যে দেখা যায় এক ভিন্ন রূপ। তিনি হাসতে শুরু করেন, কৌতুক করতে থাকেন এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানে নিয়মিত উপস্থিত হতে থাকেন। ৪৫ বছর বয়সে যখন তিনি আবারও হেভিওয়েট খেতাব জয় করেন, তখন তাকে আর আগের মতো দেখা যায়নি। যেন তিনি নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন।

ফোরম্যানের এই নতুন যাত্রা যেন এক রূপকথার মতো। তিনি এখন একটি বিশাল কোম্পানির মালিক, তার নামে তৈরি হয়েছে পণ্য, এমনকি তিনি একটি টিভি অনুষ্ঠানেও কাজ করেছেন। তার পাঁচ ছেলের নামও রেখেছেন জর্জ।

১৯৬৮ সালের সেই ঘটনার মূল শিক্ষা হলো, কৃষ্ণাঙ্গদের রাজনৈতিক মত প্রকাশের একটি নির্দিষ্ট ধরন থাকতে পারে না। সবার অভিজ্ঞতা ও প্রকাশের ধরন ভিন্ন হতে পারে। জর্জ ফোরম্যান সবসময় প্রমাণ করেছেন, একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবেও জটিল হওয়া সম্ভব।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *