জার্মানিতে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্পে দেখা গেছে যে, নিয়মিত মাসিক ভাতা পেলে মানুষের কাজের প্রতি আগ্রহ কমে না, বরং তারা আরও ভালো জীবন ধারণের সুযোগ পায়।
‘মাইন গ্রুন্ডাইংকোমেন’ নামক একটি অলাভজনক সংস্থা এই পরীক্ষাটি পরিচালনা করে।
তারা বার্লিনে বসবাসকারী ১২২ জন মানুষকে জুন ২০২১ থেকে মে ২০২৪ পর্যন্ত, টানা তিন বছর ধরে প্রতি মাসে ১,২০০ ইউরো (যা প্রায় ১৩৬৫ মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১,৫০,০০০ টাকার সমান, ৩১ মে, ২০২৪-এর বিনিময় হার অনুযায়ী) করে দিয়েছে।
এই অর্থ সরাসরি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হতো এবং এর কোনো শর্ত ছিল না।
এই গবেষণার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল এমন ব্যক্তিদের, যাদের বয়স ২১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে এবং যারা আগে থেকেই কাজ করতেন।
তাদের মাসিক আয় ছিল ১,১০০ থেকে ২,৬০০ ইউরোর মধ্যে।
এই অতিরিক্ত অর্থ তারা কিভাবে খরচ করবে, সে বিষয়ে তাদের স্বাধীনতা ছিল।
তবে, তাদের ছয় মাস অন্তর একটি প্রশ্নপত্র পূরণ করতে হতো, যেখানে তাদের আর্থিক অবস্থা, কাজের ধরন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হতো।
পরীক্ষার ফলাফল ছিল বেশ উৎসাহব্যঞ্জক।
সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, নিয়মিত অর্থ পেলে মানুষ হয়তো কাজ করা কমিয়ে দেবে।
কিন্তু এই গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ভাতা পাচ্ছিলেন, তাদের কর্মজীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
তারা আগের মতোই সপ্তাহে গড়ে ৪০ ঘণ্টা কাজ করেছেন, যা নিয়ন্ত্রণ গ্রুপের (যাদের কোনো ভাতা দেওয়া হয়নি) সদস্যদের মতোই ছিল।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নিয়মিত ভাতা পাওয়া লোকেরা তাদের কাজের প্রতি আরও বেশি সন্তুষ্ট ছিলেন।
তাদের মধ্যে নতুন চাকরি খোঁজা বা উচ্চশিক্ষার জন্য নাম লেখানোর প্রবণতাও দেখা গেছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা তাদের জীবনকে আরও মূল্যবান এবং অর্থপূর্ণ বলে মনে করেছেন।
বিশেষ করে নারীরা তাদের জীবনে স্বায়ত্তশাসন অনুভব করেছেন এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে।
তাদের মতে, আগের চেয়ে বেশি সময় পাওয়া যাচ্ছে ঘুম, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ এবং পরিবারের সঙ্গে কাটানোর জন্য।
এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অফ ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেসের অধ্যাপক সুসান ফিয়েডলার বলেন, “আমরা এমন কোনো প্রমাণ পাইনি যে, মানুষ কিছু না করে থাকতে ভালোবাসে।”
ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম বা ইউবিআই (UBI) নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের।
সমালোচকরা মনে করেন, এমন ব্যবস্থা চালু হলে কর্মস্পৃহা কমে যাবে।
তবে, এই গবেষণা সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের আয় মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তৈরি করে, যা তাদের ঝুঁকি নিতে এবং জীবনের মান উন্নত করতে সাহায্য করে।
নর্থাম্ব্রিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ম্যাথিউ জনসন মনে করেন, এই ফলাফল অপ্রত্যাশিত নয়।
তিনি বলেন, “এই গবেষণাটি প্রমাণ করে যে, মৌলিক আয় কর্মসংস্থান কমায় না।
বরং, এটি শ্রমিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেয়, যা তাদের ভালো ঝুঁকি নিতে এবং খারাপ পরিস্থিতি এড়াতে সাহায্য করে।”
উল্লেখ্য, এই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এসেছিল ব্যক্তিগত অনুদান থেকে।
এমনকি, এই প্রকল্পের জন্য আবেদন করেছিলেন ২০ লক্ষাধিক মানুষ।
ভবিষ্যতে, ‘মাইন গ্রুন্ডাইংকোমেন’ আরও বেশি সংখ্যক মানুষের উপর এই পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করছে, যাতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
তারা মনে করে, জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি—এসব কারণে কল্যাণ রাষ্ট্রের ভূমিকা এবং ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন