৮০ বছর পরও, আজও জার্মানিতে খুঁজে ফেরা হচ্ছে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের হাড়গোড়!

যুদ্ধ শেষ হওয়ার আশি বছর পরেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈন্যদের খুঁজে চলেছে জার্মানি। বার্লিনের কাছে হালবে নামক স্থানে গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে ১০৭ জন জার্মান সৈনিকের দেহাবশেষ সমাহিত করা হয়।

সৈন্যদের সম্মানে আয়োজিত এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শোকাহত স্বজন এবং স্থানীয় মানুষেরা উপস্থিত ছিলেন। জার্মানির সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখন সমাধিস্থলে তাঁদের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন, তখন অনেককেই চোখের জল ফেলতে দেখা যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি আজও ইউরোপ জুড়ে বিদ্যমান। যুদ্ধের বিভীষিকা আজও যেন শেষ হয়নি।

জার্মানির ‘ভক্সবুন্ড ডয়েচে ক্রিয়েগসগ্র্যাবারফুরসোর্গে’ নামক একটি অলাভজনক সংস্থা বহু দশক ধরে জার্মান সৈন্যদের দেহাবশেষ খুঁজে বের করা, শনাক্ত করা এবং সমাধিস্থ করার কাজটি করে চলেছে। এই কাজটি সহজ ছিল না।

যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন আজও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বনাঞ্চল, মাঠ কিংবা পুরোনো চাষের জমির নিচে আজও অনেক জার্মান সৈনিকের দেহাবশেষ পাওয়া যায়।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এত বছর পার হয়ে গেলেও, এখনো অনেক সৈন্যের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। অনেক সৈনিককে হয়তো যুদ্ধের সময় দ্রুততার সঙ্গে সমাধিস্থ করা হয়েছিল, যেখানে কোনো স্মৃতিচিহ্ন ছিল না।

আবার কারো কারো সমাধিস্থল হয়তো আধুনিক অবকাঠামোর নিচে চাপা পড়েছে, অথবা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে চলমান যুদ্ধের কারণে সেখানে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।

মার্টিনা সিইগার-এর দাদা ওয়ার্নার নভাক-এর কথা আজও তাঁর মনে আছে। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি নিহত হয়েছিলেন।

যুদ্ধ শুরুর আগে নভাক-এর বিয়ে করার কথা ছিল, এবং তিনি তাঁর সন্তানের মুখ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ১৯৪৫ সালে যখন সোভিয়েত রেড আর্মি বার্লিনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন নভাককে আবারও যুদ্ধে যেতে হয়।

এই কঠিন কাজটি এখনো চলমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলোতে, পুরনো সামরিক মানচিত্র এবং সৈন্যদের তালিকা ধরে খুঁজে চলেছে ভক্সবুন্ড। এমনকি ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলেও তাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে।

নিহত সৈন্যদের সম্মান জানাতে এবং তাঁদের একটি সম্মানজনক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য এই সংস্থাটি কাজ করে যাচ্ছে। যদিও এই সৈন্যদের অনেকেই এমন একটি সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, যারা ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য কিছু অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল।

প্রত্যেক মৃতের পেছনে একটি মানবজীবন ছিল, এবং সেটাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।

ভক্সবুন্ডের সাধারণ সম্পাদক ডিরক ব্যাকেন

তিনি আরও বলেন, “যখন আপনি ১৮ বছর বয়সী একজন তরুণ সৈনিকের কবরের সামনে দাঁড়াবেন, তখন আপনার মনে হবে, হয়তো তার জীবনে অন্য কিছু করার সুযোগ ছিল, কিন্তু সেই সুযোগ হয়নি।

৮৩ বছর বয়সী ভল্ফগ্যাং বার্শ-এর বাবা ১৯৪২ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়ার ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যান। বার্শ-এর বয়স তখন মাত্র তিন সপ্তাহ।

তাঁর মা বার্লিনে মিত্রশক্তির বোমা হামলায় নিহত হন। বার্শ তাঁর বাবার কবর খুঁজে পাননি। তাঁর বাবার আত্মার শান্তি কামনায় আজও তিনি ব্যাকুল।

ভক্সবুন্ডের হিসাব অনুযায়ী, এখনো প্রায় ২০ লক্ষ জার্মান সৈনিকের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। গত ৩০ বছরে, তারা প্রাক্তন পূর্ব জার্মানির অঞ্চলগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়ে ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষের দেহাবশেষ উদ্ধার করেছে।

পোল্যান্ডের ওস্ট্রোলেঙ্কায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈন্যদের দেহাবশেষ উত্তোলনের সময় স্থানীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ লুকাস ক্যারল-এর মনে নৈতিক দ্বিধা ছিল।

এরাও মানুষ, এবং তাদেরও একটি সমাধির অধিকার আছে।

লুকাস ক্যারল

আজকের দিনে, নিহত সৈন্যদের পরিবারের সদস্যরা হয়তো তাঁদের প্রিয়জনদের খুঁজে বের করার জন্য ততটা আগ্রহী নন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক স্মৃতি ফিকে হয়ে যায়, এবং শোকের তীব্রতাও কমে আসে।

তবে বার্শ-এর মতো মানুষের জন্য, এই বেদনা এখনো গভীর।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *