ঘড়ির জগতে ফিরছে পুরোনো জৌলুস: ডিজিটাল যুগেও টিকে থাকার লড়াই।
ডিজিটাল প্রযুক্তির এই যুগে, যেখানে স্মার্টফোন আমাদের হাতের মুঠোয়, সেখানে ঘড়ি তৈরির মতো একটি ঐতিহ্যবাহী পেশা কি এখনো টিকে থাকতে পারে? অনেকের হয়তো এমনটা মনে হতে পারে, ঘড়ি তৈরির কারিগরদের দিন বুঝি শেষ! কিন্তু না, সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে ঘড়ি তৈরির শিল্পে নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, যা এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে।
ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। আসলে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অ্যানালগ বা সনাতন জিনিসের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। কম্পিউটার স্ক্রিনের জগৎ থেকে দূরে, হাতে-কলমে কাজ করার একটা অদম্য ইচ্ছাই যেন এই পরিবর্তনের মূল কারণ। পুরনো দিনের কারুশিল্পের প্রতি এই আকর্ষণ ঘড়ি শিল্পকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে।
একটা সময় ছিল, যখন ঘড়ি শিল্পের শ্রমিক সংকট নিয়ে অনেক কথা শোনা যেত। বয়স্ক কারিগররা অবসর নেওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। সিএনএন-এর সঙ্গে কথা বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই পেশায় আগ্রহ বাড়ছে, যা বেশ আশাব্যঞ্জক।
অনলাইন ঘড়ি কমিউনিটিগুলো এই পরিবর্তনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তরুণ থেকে শুরু করে বয়স্ক—সকলেই নিজেদের ঘড়ি সংগ্রহ, দক্ষ কারিগরদের কাজ এবং পুরনো, ব্যবহৃত ঘড়ি কেনাবেচা করার সুযোগ পাচ্ছেন। টিকটক শপের মতো প্ল্যাটফর্মেও এই ধরনের ঘড়ির কেনাবেচা বাড়ছে। এর ফলে ঘড়ি মেরামতকারীর চাহিদাও বেড়েছে, যারা পুরনো দিনের মূল্যবান ঘড়িগুলো সারিয়ে তোলেন।
সুইজারল্যান্ডের ওয়াচমেকার্স অফ সুইজারল্যান্ড ট্রেনিং অ্যান্ড এডুকেশনাল প্রোগ্রামের (WOSTEP) ডিরেক্টর, ইয়োহান কুঞ্জ-ফার্নান্দেজ মনে করেন, তরুণ প্রজন্ম ঘড়ি শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। জেনেভায় অনুষ্ঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘড়ি প্রদর্শনীতে তরুণদের উপস্থিতি দেখে তিনি অবাক হয়েছিলেন। তাঁর মতে, অনেক তরুণ, বিশেষ করে অল্পবয়সীরা এখন এই শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, যা আগে দেখা যেত না।
তাহলে, কীভাবে ঘড়ির প্রতি ভালোবাসা থেকে এই পেশায় আসা যায়?
ফিনল্যান্ডের এস্পো-তে অবস্থিত কেলোসেপ্পাকৌলু নামের ঘড়ি তৈরির স্কুল এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে, সেই ১৯৪৪ সাল থেকে। এখানকার অধ্যক্ষ হান্না হারিলাইনেন জানিয়েছেন, তাঁদের স্কুলটি বিশ্বের অন্যতম সেরা ঘড়ি তৈরির স্কুল হিসেবে পরিচিত। এখানে হাতে-কলমে কাজ শেখানো হয়। বর্তমানে এই স্কুলের চাহিদা এতটাই বেড়েছে যে তারা প্রথমবারের মতো ইংরেজি ভাষায়ও একটি কোর্স চালু করতে চলেছে। হারিলাইনেন জানিয়েছেন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইরানের মতো দেশ থেকে এই কোর্সে অংশ নিতে আগ্রহীরা নাম লিখিয়েছেন।
হারিলাইনেন মনে করেন, স্বাধীন ঘড়ি প্রস্তুতকারকদের তৈরি ‘মাইক্রো-ব্র্যান্ড’-এর (ক্ষুদ্র ব্র্যান্ড) প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে। তাঁর মতে, তরুণ প্রজন্ম এমন কিছু তৈরি করতে চায়, যা টেকসই হবে এবং সহজে বাতিল হয়ে যাবে না। সম্প্রতি কেলোসেপ্পাকৌলুর এক প্রাক্তন ছাত্র একটি জনপ্রিয় স্বাধীন ঘড়ি ব্র্যান্ডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হয়েছেন এবং নিয়মিতভাবে অনলাইন লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে ঘড়ি তৈরির প্রক্রিয়া দেখান।
ফন্দেশন হাউট হরলোগেরি (FHH)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট অরেলি স্ট্রিট-এর মতে, নতুন প্রজন্মের মানুষ এমন কিছু খুঁজছে যা তাঁদের কাছে অর্থবহ। তিনি আরও যোগ করেন, ঘড়ি তৈরির কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতাও অনেককে আকর্ষণ করে। কারণ এখানে আপনি সরাসরি দেখতে পান কী করছেন, এবং এর প্রভাব কেমন হচ্ছে।
তবে, ঘড়ি তৈরি করার মতো কঠিন কাজটা সবাই কি পারে?
১৯৭০-এর দশকে বার্নহার্ড লেডারের যখন ঘড়ি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন অনেকেই এর কারণ বুঝতে পারেননি। কারণ, তখন ব্যাটারিচালিত ঘড়ির জনপ্রিয়তার কারণে সুইস অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল এবং মনে হচ্ছিল, যান্ত্রিক ঘড়ির আর ফেরা হবে না। লেডারার এই পেশাকে সবচেয়ে সুন্দর পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর তৈরি করা ঘড়িগুলো এখন দেড় লক্ষ ডলারেরও বেশি দামে বিক্রি হয়। তাঁর মতে, অতিমারীর কারণে মানুষ স্বাধীন ঘড়ি প্রস্তুতকারকদের সম্পর্কে জানতে শুরু করে এবং নিজেদের রুচি অনুযায়ী ঘড়ি খুঁজে নেয়।
যাঁরা এই পথে হেঁটেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইয়োহানেস কালিনিচ এবং থিবো ক্লয়েস। তাঁরা দু’জনে মিলে এ. ল্যাঞ্জ অ্যান্ড সোনে (A. Lange & Söhne) নামের একটি বিলাসবহুল ঘড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পর, ২০২২ সালে ‘কালিনিচ ক্লয়েস’ নামে নিজেদের ঘড়ি কোম্পানি খোলেন। জার্মানির গ্লাসহুটে শহরে তাঁদের এই কোম্পানি, যেখানে ১৮৪৫ সাল থেকে ঘড়ি তৈরির ঐতিহ্য চলে আসছে। ক্লয়েস ও কালিনিচের লক্ষ্য ছিল, ঐতিহ্যবাহী ঘড়ি তৈরিতে নতুন জীবন দেওয়া।
তাঁরা ক্লাসিক এবং আধুনিক উপাদানের মিশ্রণ ঘটিয়ে ঘড়ি তৈরি করেন। জার্মানির সিলভার (তামা, নিকেল ও জিঙ্কের সংকর) এবং স্টেইনলেস স্টিলের ব্যবহার এর উদাহরণ। তাঁদের উদ্ভাবনের মধ্যে অন্যতম হল— ঘড়ির ডায়ালের বদলে পাশে পাওয়ার রিজার্ভ ইন্ডিকেটর স্থাপন করা, যা ঘড়ির ডিজাইনকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
তবে, ঘড়ি তৈরি করার কাজটি মোটেও সহজ নয়। ক্লয়েস জানান, ঘড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি ও ফিনিশিংয়ের কাজটা বেশ কঠিন, আর কালিনিচ ডিজাইন ও অ্যাসেম্বলিংয়ের কাজটি করেন। তাঁদের মতে, ক্রেতারা তখনই কিনবেন, যখন তাঁরা ঘড়িটিকে সুন্দর হিসেবে বিবেচনা করবেন।
এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, তাঁদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। এই বছর ‘ওয়াচেস অ্যান্ড ওয়ান্ডার্স’ প্রদর্শনীতে তাঁদের ঘড়ির জার্মান ডিজাইন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তবে, তাঁদের উৎপাদন সীমিত, কারণ এই সূক্ষ্ম কাজের জন্য তাঁরা বছরে মাত্র ১০ থেকে ১২টি ঘড়ি তৈরি করার পরিকল্পনা করেছেন।
শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়, অনেকে জীবনের অন্য সময়েও এই পেশায় আসছেন। তাঁরা হয় নতুন করে তাঁদের পুরনো স্বপ্নকে বাঁচিয়ে তুলছেন, নয়তো ডেস্কের কাজের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন।
এই প্রসঙ্গে, WOSTEP-এর এক কোর্সে ৪০ বছর ব্যাংকে কাজ করার পর এক ব্যক্তির ঘড়ি তৈরি শিখতে আসার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
পুরুষদের এই পেশায় নারীদের অংশগ্রহণও বাড়ছে। তবে, এখনো এই শিল্পে নারীদের সংখ্যা কম। তরুণ ঘড়ি প্রস্তুতকারক শনা টেইন এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, এখনকার দিনে ঘড়ি তৈরি একটি শিল্প, যেখানে শিল্পীরা তাঁদের সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করতে পারেন। শনা টেইন-এর তৈরি করা ‘খিমিয়া’ নামের একটি ঘড়ির দাম প্রায় ১০৭,০০০ ডলার।
অতীতে ঘড়ি তৈরি একটি প্রয়োজনীয় পেশা ছিল, কিন্তু এখন এটি অনেকটা শিল্পকলার মতো। টেইনের মতে, ঘড়ি নির্মাতারা এখন অনেক বেশি স্বাধীনতা পান।
এই পেশায় নারীদের উপস্থিতি প্রসঙ্গে শনা জানান, অনেক সময় তাঁর লিঙ্গপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তবে তিনি মনে করেন, এটা ভালো।
অন্যদিকে, যারা এই পেশায় আসতে চান, তাঁদের মধ্যে অনেকে মনে করেন, ঘড়ি তৈরি এমন একটি শিল্প, যা পুরনো ও নতুন ধারণাকে একত্রিত করে।
সুতরাং, ডিজিটাল প্রযুক্তির এই যুগে ঘড়ি তৈরির মতো একটি ঐতিহ্যবাহী পেশা নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক।
তথ্য সূত্র: সিএনএন