বর্ষাকালে সমুদ্র ভ্রমণে সতর্কতা: ঘূর্ণিঝড়ের সময় কিভাবে নিরাপদ থাকবেন
বর্ষাকাল মানেই ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক মনোরম সময়। বিশেষ করে সমুদ্রের কাছাকাছি যারা ঘুরতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য এই সময়টা অন্যরকম আনন্দ নিয়ে আসে। তবে বর্ষাকালে, বিশেষ করে মে মাস থেকে শুরু করে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের আনাগোনা বাড়ে।
তাই এই সময়ে সমুদ্র ভ্রমণে গেলে কিছু বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। আসুন, জেনে নেওয়া যাক ঘূর্ণিঝড়ের সময় কিভাবে নিরাপদ থাকা যায়।
ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন ও টাইফুন: এরা কি একই?
আসলে, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন এবং টাইফুন – এগুলো সবই শক্তিশালী সামুদ্রিক ঝড়, যা উষ্ণ ও আর্দ্র জলীয় অঞ্চলে সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে, যা মূলত এদের বিস্তৃতি অঞ্চলের উপর নির্ভর করে।
আটলান্টিক মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট ঝড়গুলোকে ‘হারিকেন’ বলা হয়। উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে এদেরকে ‘টাইফুন’ নামে ডাকা হয়। আর ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ঝড়গুলো ‘সাইক্লোন’ নামে পরিচিত।
যেহেতু আমাদের দেশ বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি, তাই এখানে সৃষ্ট ঝড়গুলো সাইক্লোন নামেই পরিচিত।
ঘূর্ণিঝড় কিভাবে সৃষ্টি হয়?
ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য কিছু বিশেষ পরিস্থিতি প্রয়োজন। সমুদ্রের উপরিভাগের তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকতে হয়। এই তাপমাত্রায় সমুদ্রের জল দ্রুত বাষ্পীভূত হয়ে মেঘ তৈরি করে।
জলীয় বাষ্প উপরে উঠলে সেখানকার বাতাস হালকা হয়ে যায় এবং সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে আসে শীতল বাতাস। এভাবে একটি চক্র তৈরি হয়, যা ঝড়ের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
এছাড়াও, পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে সৃষ্ট কোরিওলিস বলের প্রভাবেও ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়।
কখন ঘূর্ণিঝড় মৌসুম?
সাধারণত, উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলে ১লা জুন থেকে ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে হারিকেন দেখা যায়। তবে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে এই সময়সীমা ১৫ই মে থেকে ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত।
টাইফুনগুলো সারা বছর দেখা গেলেও জুলাই থেকে নভেম্বরের মধ্যে এদের প্রভাব বেশি থাকে। আর আমাদের দেশের জন্য, ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুম সাধারণত অক্টোবর মাসের শেষ থেকে মে মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
ভ্রমণের আগে কি প্রস্তুতি নেবেন?
ঘূর্ণিঝড় একটি অনিশ্চিত বিষয়। অনেক সময় এটি দুর্বল হয়ে যায়, আবার কখনো এটি দিক পরিবর্তন করে মারাত্মক রূপ নেয়। তাই, ভ্রমণের আগে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
- আবহাওয়া সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন: ভ্রমণের আগে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস দেখুন। এছাড়া, ভ্রমণের সময়ও নিয়মিত আবহাওয়ার খবর রাখুন।
- জরুরি জিনিস সঙ্গে নিন: টর্চলাইট, সৌর-চার্জার, শুকনো খাবার, ছোট আকারের নগদ টাকা (যেমন: ১০০, ৫০ টাকার নোট) এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ অবশ্যই সাথে রাখুন।
- হোটেল বা আবাসনের ব্যবস্থা: আপনি যেখানে থাকবেন, সেখানকার কর্তৃপক্ষের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য তাদের কি কি ব্যবস্থা আছে, তা জেনে নিন। তাদের আশ্রয়কেন্দ্র আছে কিনা, জরুরি অবস্থার জন্য খাবার ও পানীয় মজুত আছে কিনা, এইসব বিষয়গুলো জেনে রাখা ভালো।
- পরিবর্তনযোগ্য ভ্রমণের পরিকল্পনা: যদি ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস থাকে, তাহলে আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা পরিবর্তন করার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
ভ্রমণ বীমা কি ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিপূরণ দেয়?
ভ্রমণ বীমা পলিসি নেওয়ার আগে ভালোভাবে জেনে নিন, এটি ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সৃষ্ট ক্ষতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কিনা। সাধারণত, কোনো ঝড়ের নামকরণ হওয়ার পরে যদি আপনি বীমা করান, তাহলে সেটি ‘পূর্ব-জ্ঞাত ঘটনা’ হিসেবে ধরা হয় এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
যদি আপনার ভ্রমণে কোনো সমস্যা হয়, তাহলে প্রথমে আপনার ট্রাভেল এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করুন। অনেক সময় তারা পরিস্থিতি বিবেচনা করে ভ্রমণের তারিখ পরিবর্তন করতে রাজি হয়।
ঝড়ের পরে কি ভ্রমণ করা উচিত?
একটি বড় ঝড়ের পরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ভ্রমণ করা স্থানীয় মানুষের জন্য সহায়ক হতে পারে। কারণ পর্যটকদের আনাগোনা সেখানকার অর্থনীতিকে দ্রুত পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে।
তবে, ভ্রমণের আগে অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে নিন যে এলাকাটি ভ্রমণের জন্য নিরাপদ কিনা। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পর্যটন আবার শুরু হতে পারে।
সবশেষে, ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্র ভ্রমণে সতর্কতা অবলম্বন করা যেমন জরুরি, তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোও আমাদের দায়িত্ব। তাই, ভ্রমণ করার আগে সচেতন থাকুন, নিরাপদে থাকুন এবং অন্যদেরও সচেতন করুন।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক