বরফ গলা: ২ বিলিয়ন মানুষের খাদ্য ও জলের সংকট, সতর্ক করল জাতিসংঘ
জাতিসংঘের এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে হিমবাহ দ্রুত গলতে থাকায় ২ বিলিয়ন মানুষের খাদ্য এবং জলের নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পার্বত্য অঞ্চলে বরফ গলার এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি চলছে, যার ফলস্বরূপ বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সেচযুক্ত কৃষি জমি হিমবাহের পশ্চাদপসরণ এবং পার্বত্য অঞ্চলের তুষারপাতের অভাবে কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে ১ বিলিয়নের বেশি মানুষ পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করে, যার মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্ধেকের বেশি মানুষ ইতোমধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার।
বিশ্ব জল উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২৫ অনুসারে, এই অঞ্চলের খাদ্য উৎপাদন পর্বত-নির্ভর জল, গলিত বরফ ও হিমবাহের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদী অববাহিকা অঞ্চলে ২০০০ সাল থেকে খরা দেখা দিয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে, যা দ্রুত নদীগুলোতে জলপ্রবাহ বৃদ্ধি করে এবং খরার পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলছে।
আমরা যেখানেই বাস করি না কেন, কোনো না কোনোভাবে আমরা সবাই পাহাড় এবং হিমবাহের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই প্রাকৃতিক জলস্তম্ভগুলো এখন আসন্ন বিপদের সম্মুখীন। এই প্রতিবেদন জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) তাদের বার্ষিক জলবায়ু পরিস্থিতি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, হিমবাহের পরিবর্তন রেকর্ড-সংখ্যক হারে বাড়ছে। গত তিন বছরে হিমবাহের ভর সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে।
নরওয়ে, সুইডেন, এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের আন্দিজ পর্বতমালা এর দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পূর্ব আফ্রিকায় ইতিমধ্যে ৮০ শতাংশ হিমবাহ বিলীন হয়ে গেছে। আন্দিজ অঞ্চলে ১৯৯৮ সাল থেকে এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত হিমবাহ গলে গেছে।
ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা আল্পস ও পিরিনিস-এর হিমবাহগুলো প্রায় ৪০ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। ইউনেস্কোর জল বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক আবু আমানি বলেন, “হিমবাহের বরফ গলার কারণে প্রতিফলিত পৃষ্ঠের পরিবর্তে কালো মাটি উন্মোচিত হচ্ছে, যা তাপ শোষণ করে।
এর ফলে সৌর বিকিরণের প্রতিফলন ক্ষমতা হ্রাস পায়, যা পুরো জলবায়ু ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে।
হিমবাহ গলতে শুরু করলে ভূমিধসের ঘটনাও বাড়ে। তুষারের ওপর বৃষ্টি পড়লে তা ভূমিধসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এছাড়াও, গলিত বরফের জল জমে হঠাৎ করে উপত্যকাগুলোতে বন্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি যারা পাহাড়ের ঢালুতে বাস করে, তাদের জীবনও এতে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
পার্মাফ্রস্ট (permafrost) গলতে শুরু করায় এর ভেতর থেকে মিথেন গ্যাস নির্গত হচ্ছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে আরও বেশি প্রভাব ফেলছে।
গত মাসে ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, যদি বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে শতাব্দীর শেষ নাগাদ পৃথিবীর অর্ধেক হিমবাহ বিলীন হয়ে যাবে।
পাহাড়ের হিমবাহগুলোতে পৃথিবীর বৃহত্তম স্বাদু জলের ভাণ্ডার বিদ্যমান। গ্রীষ্মকালে এই বরফ গলা জল ১ বিলিয়ন মানুষের জল সরবরাহ করে এবং বিপুল পরিমাণ শিল্প ও কৃষিকাজকে টিকিয়ে রাখে। এর প্রভাব হিমবাহের কাছাকাছি অঞ্চলের বাইরেও অনুভূত হবে।
আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) প্রেসিডেন্ট এবং জাতিসংঘের জল বিভাগের চেয়ারম্যান আলভারো লারিও ক্ষতিগ্রস্ত পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জন্য আরও সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন।
জল নিচের দিকে প্রবাহিত হয়, কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা উপরের দিকে বাড়ে। পর্বতমালা আমাদের স্বাদু জলের ৬০ শতাংশ সরবরাহ করে, অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলোর রক্ষক সম্প্রদায়গুলোই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার।
হিমালয় অঞ্চলে অবস্থিত হিমবাহগুলো থেকে আসা জলধারা বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা (জিবিএম) নদী অববাহিকা হিমালয়ের বরফের ওপর নির্ভরশীল। তাই হিমবাহের এই দ্রুত গলন বাংলাদেশের জল সম্পদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
আমাদের এখনই এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপ নিতে হবে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান