ছোটবেলায় রূপকথার গল্প শুনে বড় হওয়া ভিনসেন্ট থারকেটল-এর রক্তে যেন মিশে ছিল অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। ৬০-এর দশকে দক্ষিণ ওয়েলসে বেড়ে ওঠা এই মানুষটির জীবনে প্রকৃতি আর কৌতূহল হাত ধরে এসেছিল।
বাবার রয়্যাল নেভিতে চাকরির সুবাদে নৌবাহিনীর গল্প শুনতে শুনতে তাঁর শৈশব কেটেছে, আর মায়ের উৎসাহে বনের গভীরে খেলাধুলা করে প্রকৃতির কাছাকাছি এসেছেন তিনি। পরিণত বয়সে, প্রকৃতির প্রতি এই টান তাঁকে এক নতুন পথে নিয়ে যায়, যাঁর চূড়ান্ত পরিণতি তিনি নিজেও হয়তো কল্পনা করেননি।
একদিন, তাঁর বয়স যখন কুড়ি পেরিয়েছে, পরিত্যক্ত একটি খনির আশেপাশে ঘুরতে গিয়েছিলেন ভিনসেন্ট। সেখানেই তাঁর আলাপ হয় কয়েকজন স্বর্ণসন্ধানীর সঙ্গে। তাঁদের কথা শুনে, ভিক্টোরিয়ান যুগের সেই স্বর্ণ-আবিষ্কারের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে তাঁর।
আগে কখনো ভাবেননি যে, এখনো সোনার খোঁজে মানুষ এতটা আগ্রহী হতে পারে। তাঁদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলার পর, তাঁর মনেও সোনার প্রতি আকর্ষণ জন্মায়।
এরপর, উত্তর ওয়েলসে গিয়ে তিনি একটি সোনার ঝাঁকনি (gold pan) হাতে নিলেন। আট দিন ধরে পাহাড়ে তাঁবু গেড়ে, নদীর পানিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পাথর আর বালি থেকে সোনার কণা খুঁজেছেন। দ্বিতীয় দিনেই তাঁর ভাগ্য খুলে যায়।
নদীর বুকে সামান্য কিছু সোনার কণা খুঁজে পাওয়ার পরেই যেন তাঁর নেশা ধরে যায়। তাঁর মনে হয়েছিল, এটাই তাঁর আসল ঠিকানা।
ছোট্ট সোনার কণাগুলো নিয়ে যখন তিনি বাড়ি ফিরলেন, মা-বাবার চোখে তেমন উৎসাহ দেখতে পাননি। বরং মায়ের প্রশ্ন ছিল, ‘এই তো?’ বাবার নীরবতা যেন তাঁর সেই স্বপ্নের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিল।
ভিনসেন্ট থারকেটলের মতে, সোনার খোঁজে বের হওয়াটা আসলে অর্থ উপার্জনের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এর মধ্যে একটা শৈশবসুলভ আনন্দ আছে। এখনো, ৬৯ বছর বয়সেও, তাঁর ভেতরের সেই কিশোরটি জেগে ওঠে, যে অভিযানে যেতে ভালোবাসে।
তিনি দিনের পর দিন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকেন, ধীরে ধীরে পাথর সরিয়ে সোনার কণা খুঁজে বেড়ান। প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের এক দারুণ উপায় এটি।
২০০৭ সালে, কানাডায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বর্ণ প্যানিং চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রিটিশ দলের হয়ে নেতৃত্ব দেন ভিনসেন্ট। তাঁর দল প্রথম স্থান অধিকার করে। মজার বিষয় হল, তাঁদের পাওয়া সোনার মেডেলগুলো বেশি দিন টেকসই হয়নি, কারণ সেগুলো আসল সোনা দিয়ে তৈরি ছিল না।
এই ধরনের প্রতিযোগিতা সাধারণত গণমাধ্যমে খুব একটা আসে না, তাই এটি যেন একটি গোপন জগৎ।
প্রতিযোগিতায়, প্রত্যেক দলকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সোনার কণা খুঁজে বের করতে দেওয়া হয়। বিজয়ী সেই দল, যারা সবার আগে সব কণা খুঁজে বের করতে পারে। প্রতিযোগিতা বেশ কঠিন হলেও, তিনি সারা বিশ্ব থেকে অনেক বন্ধু তৈরি করেছেন।
৪৯ বছর বয়সে, বিপণন (marketing) বিভাগের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি পুরোদমে সোনার খোঁজে নামেন। তাঁর এই পেশা জীবনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারটি ঘটে ২০১২ সালে।
সেবার তিনি ৯৭ গ্রামের একটি সোনার খণ্ড খুঁজে পান, যা সেসময় যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় সোনার আবিষ্কার ছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল উত্তর ওয়েলসের উপকূলে, যেখানে ১৮৫৯ সালে ‘রয়্যাল চার্টার’ নামে একটি ভিক্টোরিয়ান যুগের যাত্রীবাহী জাহাজ ডুবে গিয়েছিল।
১১ বছর ধরে তিনি ডুবুরিদের একটি দল তৈরি করে ওই জাহাজের ধ্বংসাবশেষে তল্লাশি চালিয়েছিলেন। একদিন, মাটির ফাটলের মধ্যে সোনার মতো আভা দেখতে পান তিনি। ডিমের আকারের সেই সোনার খণ্ডটি ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার।
এত বছর সোনা খুঁজেও এমন আকারের সোনার খণ্ড তিনি দেখেননি। এটি ছিল একইসঙ্গে বিপজ্জনক এবং আনন্দ-জাগানো এক অভিজ্ঞতা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সোনার খণ্ডটির মূল্য সে সময় প্রায় ৫০,০০০ পাউন্ড হতে পারতো, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৬১ লক্ষ টাকার সমান (২০১২ সালের বিনিময় হার)। বর্তমানে, এর মূল্য আরও অনেক বেশি, যা প্রায় ৭৬ লক্ষ টাকার কাছাকাছি (২০২৪ সালের বিনিময় হার)। যেহেতু এটি একটি ঐতিহাসিক আবিষ্কার, তাই তিনি এটি ট্রেজার কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেন।
অনেকে তাঁকে বলেছিলেন, সোনাটা নিজের কাছে রাখতে, কিন্তু তাঁর মতে, এই সোনা জাদুঘরে রাখা উচিত, যাতে ‘রয়্যাল চার্টার’-এর ক্ষতিগ্রস্তদের গল্প মানুষের মাঝে বেঁচে থাকে।
বর্তমানে, ভিনসেন্ট জুয়েলারি বা শিল্পকর্মের জন্য সোনা সরবরাহ করেন। এছাড়াও, তিনি সোনার সন্ধান বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন। প্রায়ই, তাঁর কাছে এমন চিঠি আসে যেখানে মানুষ সোনার খোঁজে নামতে চায়, যাতে তারা তাঁদের বন্ধকী ঋণ পরিশোধ করতে পারে।
তিনি তাঁদের সবসময় বলেন, যদি দ্রুত ধনী হওয়ার আশা থাকে, তাহলে সোনার খোঁজে না যাওয়াই ভালো। তাঁর মতে, সোনা খুঁজে যদি তিনি অনেক টাকা পেতেন, তাহলে এতদিনে হয়তো নিজের বন্ধকী ঋণ পরিশোধ করে ফেলতেন।
ভিনসেন্ট তাঁর অফিসের এক সহকর্মীকে সোনার খোঁজার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন। এখন তাঁরা দুজনে একসঙ্গে সোনার সন্ধান করেন। তাঁর ধারণা, তাঁর সঙ্গিনী সম্ভবত তাঁর চেয়েও ভালো সোনা খুঁজে বের করতে পারেন।
তাঁর মতে, এর চেয়ে ভালো কিছু দিয়ে তো ঘর ভরানো যেতেই পারে।
এই বিস্মৃতপ্রায় দক্ষতা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াটা তাঁর কাছে অনেক আনন্দের। তাঁর মেয়েও এখন সোনা খুঁজতে ভালোবাসে। এমনকি তাঁর নাতি-নাতনিদেরও তিনি প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যান এবং এই সুন্দর পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
তিনি চান, তাঁদের জীবনও তাঁর মতোই সমৃদ্ধ হোক।
তথ্য সূত্র: The Guardian