ভিনগ্রহীরা কি শুনবে পৃথিবীর গান? গোল্ডেন রেকর্ড-এর অজানা কাহিনী!

মহাকাশে বার্তা: ভয়েজার ১ ও ২ এবং পৃথিবীর গল্প

১৯৭৭ সালে ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে যাত্রা শুরু করেছিল নাসা’র ভয়েজার ১ ও ২ মহাকাশযান দুটি।

সৌরজগতের প্রান্তসীমায় পরিভ্রমণের উদ্দেশ্যে এদের পাঠানো হলেও, এদের সঙ্গে ছিল বিশেষ এক বার্তা— ‘গোল্ডেন রেকর্ডস’। সোনার প্রলেপ দেওয়া এই ডিস্কগুলোতে ধারণ করা ছিল পৃথিবীর সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং মানুষের জীবনযাত্রার নানা চিত্র।

কোনো ভিনগ্রহের প্রাণীর সাথে যোগাযোগের সম্ভাবনা থেকেই এই উদ্যোগ।

এই গোল্ডেন রেকর্ডস আসলে ছিল মহাকাশে পাঠানো ‘বার্তা-বোতল’-এর মতো।

কোনো ভিনগ্রহবাসী যদি কোনোদিন এই যানগুলি খুঁজে পায়, তাহলে তারা যেন জানতে পারে, কেমন ছিল আমাদের এই পৃথিবী, কেমন ছিল এখানকার মানুষ।

বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান এই প্রকল্পের নেতৃত্বে ছিলেন।

তাঁর তত্ত্বাবধানে বিজ্ঞানীরা, শিল্পী এবং প্রকৌশলীরা মিলে তৈরি করেছিলেন এই আন্তনাক্ষত্রিক বার্তা।

ডিস্কগুলোতে ছিল প্রকৃতির শব্দ, যেমন পাখির কলকাকলি, তিমি মাছের গান, এমনকি শিশুদের হাসির শব্দও।

এছাড়াও ছিল মোৎসার্ট, বাখ, বিটোফেন, স্ত্রাভিন্স্কি’র মতো পশ্চিমা ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত, সেনেগালিজ বাদ্যযন্ত্রের সুর, অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের গান এবং চাক বেরির ‘জনি বি গুড’-এর মতো গান।

শুধু তাই নয়, এতে ছিল পৃথিবীর মানুষের হাসি-কান্না, হৃদস্পন্দন এবং মস্তিষ্কের তরঙ্গও।

সব মিলিয়ে প্রায় ৯০ মিনিটের গান রেকর্ড করা হয়েছিল।

রেকর্ডে ৫৬টি ভাষায় শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো হয়েছিল, যা বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যেকার সংযোগের প্রতীক।

এছাড়াও, ১১৫টি ছবিতে পৃথিবীর মানুষ ও প্রকৃতির ছবি ছিল, যা আমাদের এই গ্রহের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।

রেকর্ডগুলোর বাইরের অংশে ছিল একটি মানচিত্র, যা নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থান চিহ্নিত করে পৃথিবীর ঠিকানা জানাতে সাহায্য করবে।

সেই সাথে হাইড্রোজেন পরমাণুর চিত্র এবং রেকর্ডটি বাজানোর নির্দেশনাবলীও খোদাই করা ছিল।

ভয়েজার মহাকাশযানগুলো ঘণ্টায় প্রায় ৩৫,০০০ মাইল বেগে সৌরজগতের দূরতম গ্রহগুলির পাশ দিয়ে গেছে।

এর মাধ্যমে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুনের বিস্তারিত ছবিও পৃথিবীতে পাঠানো সম্ভব হয়েছিল।

এই অভিযানে প্রাপ্ত তথ্য আমাদের সৌরজগতের গঠন ও প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছে।

বর্তমানে, ভয়েজার ১ পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ বিলিয়ন মাইল এবং ভয়েজার ২ প্রায় ১৩ বিলিয়ন মাইল দূরে রয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের শক্তি ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে।

তবে, এই যানগুলো থেকে এখনও তথ্য আসছে, যা আমাদের জন্য বিশাল এক অর্জন।

বর্তমানে, মিশনে থাকা বিজ্ঞানীরা যানগুলোর আয়ু বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ বন্ধ করে শক্তির ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করছেন।

ভয়েজার মিশনের বর্তমান প্রকল্প ব্যবস্থাপক সুজান “সুজি” ডড মনে করেন, এই অভিযান শেষ হওয়ার পরেও গোল্ডেন রেকর্ডসগুলি অনন্তকাল ধরে মহাকাশে ভেসে বেড়াবে।

এই রেকর্ডগুলি আমাদের পৃথিবীর একটি ক্ষুদ্র অংশ, মানবজাতির একটি প্রতিচ্ছবি বহন করে ছায়াপথের কেন্দ্রে ভ্রমণ করবে, যা সম্ভবত কোনো একদিন অন্য কোনো সত্তা খুঁজে পাবে।

সুজান “সুজি” ডড

ভবিষ্যতে, প্রায় ৪০,০০০ বছর পর ভয়েজার ১ গ্লিস ৪৪৫ নামক একটি তারার কাছাকাছি এবং ভয়েজার ২ রস ২৪৮ নামক একটি তারার কাছাকাছি পৌঁছাবে।

গোল্ডেন রেকর্ডস-এর ধারণা বিজ্ঞান এবং কল্পনার এক দারুণ মিশ্রণ।

এই মিশনগুলো মানুষের অনুসন্ধিৎসা, আশা এবং মহাবিশ্বে নিজেদের স্থান চিহ্নিত করার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা হয়তো এই বার্তাগুলো থেকে পৃথিবীর মানুষের সম্পর্কে জানতে পারবেন।

তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *