গরিলাদের মুক্তি: ভয়ঙ্কর জীবন থেকে বন্য পরিবেশে ফেরা!

আফ্রিকার জঙ্গলে, বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা গরিলাদের জীবনে নতুন আলো। কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (DRC) ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্কে এক ঐতিহাসিক উদ্যোগে বন্য পরিবেশে ফেরানো হয়েছে চারটি স্ত্রী গরিলাকে।

চোরাচালানকারীদের কবল থেকে উদ্ধার করে তাদের পুনর্বাসন করা হয়, এরপর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

গত বছর, অক্টোবর মাসে, ইসাঙ্গি, লুলিংগু, মাপেন্দো এবং ন্দিনগালা নামের এই চারটি গরিলাকে উদ্ধার করে GRACE (Gorilla Rehabilitation and Conservation Education Center)-এ আনা হয়। ছোটবেলায় বন্য জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এরা GRACE-এ আশ্রয় নেয়।

এখানে দীর্ঘ সময় ধরে বন্য পরিবেশে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাদের। বুনো খাবার সংগ্রহ করা এবং সামাজিক মেলামেশার কৌশল শেখানো হয়।

বন্য পরিবেশে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় মাউন্ট তিশাবেরিমু-তে, যা স্থানীয় ভাষায় ‘আত্মাদের পাহাড়’ নামে পরিচিত। এই পাহাড়টি ১,৭০০ মিটার উঁচু এবং ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্কের উত্তর অংশে অবস্থিত।

গরিলাগুলোকে প্রথমে একটি বেড়া দেওয়া স্থানে রাখা হয়েছিল, কিন্তু তাদের বন্য পরিবেশে ফেরার প্রক্রিয়াটি ছিল খুবই দ্রুত। পর্যবেক্ষক দল ভেবেছিল, এই পরিবর্তনে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, মাত্র দুই মাসের মধ্যেই তারা বন্য পরিবেশে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে। GRACE Gorillas-এর নির্বাহী পরিচালক ও বিজ্ঞান বিষয়ক পরিচালক কেটি ফসেট জানান, “আমরা সবাই যা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে অনেক দ্রুত সব কিছু হয়ে গেছে।”

এর কারণ হিসেবে জানা যায়, বন্য পরিবেশে থাকা একটি শক্তিশালী পুরুষ গরিলা, যার নাম মওয়াসা, তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। মওয়াসা নিয়মিতভাবে বেড়ার কাছে আসত এবং তার বাহু দিয়ে আঘাত করে স্ত্রী গরিলাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করত।

তার ডাকে সাড়া দিয়ে স্ত্রী গরিলাগুলো তাদের আশ্রয়স্থল ছেড়ে মওয়াসার কাছাকাছি এসে ঘুমাতে শুরু করে।

পর্যবেক্ষণ দলের সদস্যরা মনে করেন, এটাই তাদের বন্য জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত সময়। কেটি ফসেট বলেন, “আমরা সবসময় গরিলাদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছি। মওয়াসার প্রতি তাদের আগ্রহ দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, তাদের মুক্ত করে দেওয়া হোক।”

এরপর বেড়া কেটে দেওয়া হয় এবং গরিলাগুলো ধীরে ধীরে বন্য পরিবেশে মিশে যায়।

বর্তমানে, গরিলাগুলো পাহাড়ের ঠান্ডা আবহাওয়ায় এবং বাঁশ ও অন্যান্য স্থানীয় উদ্ভিদের নতুন খাদ্যাভ্যাসে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা তাদের স্বাস্থ্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন এবং কোনো প্রকার মানসিক চাপ বা অসুস্থতার লক্ষণ পাননি।

কেটি ফসেট জানান, তারা এখন বেশ সুস্থ ও সবল দেখাচ্ছে।

সবচেয়ে আনন্দের খবর হল, নতুন বছরে মওয়াসাকে ১৬ বছর বয়সী স্ত্রী গরিলা ন্দিনগালার সঙ্গে সঙ্গম করতে দেখা গেছে। ফসেট আরও জানান, অন্যান্য স্ত্রী গরিলাদেরও মওয়াসার সঙ্গে মিলিত হতে দেখা গেছে।

গরিলাদের গর্ভধারণের সময় মানুষের মতোই, তাই সেপ্টেম্বরে নতুন সদস্যের আগমনের অপেক্ষায় রয়েছে সবাই। তবে, GRACE-এ থাকাকালীন স্ত্রী গরিলাদের প্রজনন ক্ষমতা রোধ করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তাই সবাই সতর্কতার সঙ্গে অপেক্ষা করছে।

এই ঘটনাটি সমগ্র গরিলা প্রজাতির জন্য একটি বিশাল আশার আলো। পূর্বাঞ্চলীয় নিম্নভূমির গরিলা, বা গ্রাউয়ার্স গরিলা, DRC-র নিচু অঞ্চলের গ্রীষ্মমন্ডলীয় বৃষ্টি বনগুলোতে পাওয়া যায়। এই প্রজাতিটি গরিলাদের চারটি উপ-প্রজাতির মধ্যে বৃহত্তম এবং বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়।

যদিও অতীতে পশ্চিমাঞ্চলীয় নিম্নভূমির গরিলাদের সফলভাবে স্থানান্তরের ঘটনা ঘটেছে, তবে পূর্বাঞ্চলীয় গরিলাদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। মুক্তির কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাদের মৃত্যু হয়েছে অথবা তারা হারিয়ে গেছে।

এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হল মাউন্ট তিশাবেরিমু-তে বসবাসকারী আটটি গরিলা-সংখ্যার ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবন রক্ষা করা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, নতুন স্ত্রী গরিলাদের আগমন না ঘটলে এই প্রজাতিটি ২০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যেত।

তবে, এই অঞ্চলে কাজ করাটা সহজ নয়। ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্কে দশকের পর দশক ধরে সশস্ত্র সংঘাত চলছে। ১৯২৫ সালে পার্কটি তৈরি হওয়ার পর থেকে এরই মধ্যে ২০০ জনের বেশি বনরক্ষীকে হত্যা করা হয়েছে।

সম্প্রতি এম২৩ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থান পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। GRACE Gorillas-এর DRC-র পরিচালক জ্যাকসন কাবেয়া এমবেকের মতে, “এখানে কাজ করা কঠিন, তবে আমরা স্থানীয় জনগনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করি।”

বনভূমি ধ্বংস করে কৃষি ও জ্বালানির জন্য গাছ কাটার ফলে গরিলাদের আবাসস্থল হুমকির মুখে পড়ছে। সংঘাতের সময়, যখন মানুষের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়ে, তখন গরিলা শিকারের ঘটনাও বাড়ে।

এই পুনর্বাসন একটি বিশাল সাফল্য, তবে এটি কেবল শুরু। ফসেট বলেন, “এই অঞ্চলে গরিলা সংরক্ষণের মূল চাবিকাঠি হল বনভূমি রক্ষা করা। আমরা এই ফলাফলে খুবই আনন্দিত এবং আশা করি, এটি সংকটপূর্ণ অবস্থায় থাকা অন্যান্য প্রজাতিকে সাহায্য করবে।”

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *