আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধারে ইনুইট ঐতিহ্য, চমক জাগানো আন্দোলনে গ্রিনল্যান্ড!

গ্রিনল্যান্ড: আদিবাসী ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ইনুইটদের সংগ্রাম

বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ গ্রিনল্যান্ডে, সেখানকার আদিবাসী ইনুইট সম্প্রদায় তাদের প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের শিকড় পুনরুদ্ধারের এক গুরুত্বপূর্ণ মিশনে নেমেছে। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাবে নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হওয়া এই মানুষগুলো এখন আবার তাদের নিজস্ব পরিচয় ফিরে পেতে চাইছে।

এর অংশ হিসেবে তারা প্রাক-খ্রিস্টান ইনুইট ঐতিহ্যকে নতুন করে গ্রহণ করছে, যার মধ্যে রয়েছে ড্রাম বাজানো এবং ঐতিহ্যবাহী ট্যাটু বা উল্কি আঁকা।

ইনুইটদের এই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হলেন আভিয়াজা রাকেল সানিমুইনাক। তিনি একজন শামান (ঐন্দ্রজালিক), যিনি ইনুইটদের ঐতিহ্যবাহী উল্কি ধারণ করেন।

সানিমুইনাক তার আধ্যাত্মিক চিকিৎসার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে তাদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা মানসিক আঘাত থেকে মুক্তি দিতে কাজ করেন।

গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী নুকের (Nuuk) তার স্টুডিওর বাইরে একটি সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, “আধুনিক বিশ্বে প্রাচীন জ্ঞান।

ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের এই আগ্রহের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সানিমুইনাক বলেন, “খ্রিস্টান ধর্মের পবিত্রতা আমার চোখে এখনো পবিত্র। তবে বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম এবং আমার কাজও একইভাবে পবিত্র।

সিল মাছের মাথার খুলি, কাকের পালক এবং ভেষজ উদ্ভিদের মাঝে বসে তিনি আরও যোগ করেন, “আমাদের সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ এবং মানুষ হিসেবে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই কাজটি জরুরি। আমাদের সংস্কৃতি যে বৈধ, তার একটি স্থান এখানে থাকতেই হবে।

ইনুইটদের জীবনযাত্রা:

ইনুইটরা উত্তর আমেরিকার আর্কটিক অঞ্চল এবং গ্রিনল্যান্ডে বসবাস করে। তারা এক কঠিন জীবন ধারণ করে।

সিল, তিমি এবং মেরু ভালুকের শিকার করে তারা টিকে থাকে। তাদের ঐতিহ্যবাহী ধর্ম হলো অ্যানিমিজম, যেখানে তারা বিশ্বাস করে, প্রতিটি প্রাণী, পাখি, পাথর, এমনকি বৃষ্টি ও তুষারেরও একটি আত্মা আছে এবং তাদের প্রতি সম্মান জানানো উচিত।

ঐতিহ্যবাহী ট্যাটু:

ইনুইটদের সংস্কৃতিতে ট্যাটুর একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। “টুনিইত” নামে পরিচিত এই উল্কিগুলো তৈরি করা হতো পাথরের প্রদীপ থেকে পাওয়া কালি দিয়ে চামড়ার ওপর সূঁচ ফুটিয়ে বা সুতা ব্যবহার করে।

আগে নারীরা ঋতুস্রাব এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় নিজেদের সুরক্ষার জন্য ট্যাটু ব্যবহার করতেন। কিন্তু মিশনারিরা এই ট্যাটুকে “পাগান” আখ্যা দিয়ে এর বিরোধিতা করেন।

তাদের মতে, শরীরের ওপর কোনো চিহ্ন থাকা ঈশ্বরের সৃষ্টির অবমাননা।

ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের পথে বাধা:

ইনুইটদের সংস্কৃতি রক্ষার এই লড়াই মোটেও সহজ ছিল না।

একসময় তাদের ড্রাম বাজানো এবং মুখের উল্কি আঁকাকে খ্রিস্টান বানানোর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দমন করা হয়েছিল।

এমনকি শিশুদের পরিবার থেকে আলাদা করে ডেনিশ সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে নারীদের শরীরে ইন্ট্রাইউটেরাইন কন্ট্রাসেপটিভ ডিভাইস (আইইউডি) স্থাপন করা হয়েছিল।

তবে বর্তমানে, গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। এখানকার মানুষজন তাদের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলছে এবং তাদের ওপর ডেনমার্কের শাসনের অতীত অত্যাচারের বিষয়েও সোচ্চার হচ্ছে।

অনেকে মনে করেন, তাদের দেশের খনিজ সম্পদের কারণে বিশ্বজুড়ে মনোযোগ আকর্ষণ এবং ডেনমার্ক থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তাদের এই বিষয়ে আরও বেশি মুখ খুলতে সাহায্য করেছে।

ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের এই লড়াইয়ে নতুন প্রজন্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাজা পারনুনার মতো অনেক তরুণ-তরুণী এখন নিজেদের ইনুইট সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।

নাজা একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী ও গীতিকার। তিনি বলেন, “আমি অনুভব করি, নিজেদের শিকড়কে গ্রহণ করা, আত্ম-সম্মান ও আত্ম-মর্যাদা তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এর মাধ্যমে আমরা একটি স্বাস্থ্যকর জীবন এবং বিশ্বের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারি।

মার্কাস ওলসেন: পরিবর্তনের অগ্রদূত:

মার্কাস ওলসেন নামের একজন সাবেক লুথারান পাদ্রী ইনুইট ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী ইনুইট ড্রাম “কিলাত”-কে চার্চের অনুষ্ঠানে ফিরিয়ে আনার পক্ষে ছিলেন।

এই কারণে তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওলসেন মনে করেন, ইনুইটদের ঐতিহ্যকে তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা উচিত।

ইনুইটদের এই সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম প্রমাণ করে, মানুষ তার শেকড়ের টানে সবসময় ফিরে আসে।

তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং পরিচয়ের মাধ্যমে নিজেদের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে চায়।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *