সুখ: জীবনের আসল চাবিকাঠি নাকি অন্য কিছু?

সুখের সংজ্ঞা : ভালো থাকার অন্য দিক

আমরা যখন ভালো থাকার কথা ভাবি, তখন আমাদের মনে প্রথমেই কি আসে? স্বাভাবিকভাবেই, সুখ। জীবনের ভালো-মন্দ বিচার করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই সুখের মাপকাঠি ব্যবহার করি।

কিন্তু ভালো থাকার ধারণাটি কি শুধুই সুখের মধ্যে সীমাবদ্ধ? মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ভালো থাকার ধারণাটি আরও অনেক গভীর এবং এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে সংস্কৃতি ও সমাজের বিভিন্ন দিক।

পাশ্চাত্য সমাজে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে, সুখকে প্রায়ই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই ধারণাটি সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল সুখের দুটি ভিন্ন রূপের কথা বলেছিলেন – ‘হেডোনিয়া’ এবং ‘ইউডাইমোনিয়া’।

‘হেডোনিয়া’ হলো তাৎক্ষণিক আনন্দ বা সুখ, যা ক্ষণস্থায়ী। অন্যদিকে, ‘ইউডাইমোনিয়া’ হলো গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী সুখ, যা জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া এবং নিজের ভেতরের সম্ভাবনাকে বিকশিত করার সঙ্গে সম্পর্কিত।

জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির গবেষক ডেভিড ইয়েডেন এর মতে, ‘ইউডাইমোনিয়া’ হলো নিজের শক্তিকে ভালো কাজে লাগানো এবং ভালো গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলা।

বর্তমান গবেষণায়, ভালো থাকার ধারণাটিকে ‘হেডোনিয়া’ এবং ‘ইউডাইমোনিয়া’-র ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা হয়। এর মধ্যে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন এবং জীবন ধারণের সন্তুষ্টি উভয়ই অন্তর্ভুক্ত।

তবে, সুখই কি বিশ্বজুড়ে ভালো থাকার মূল ভিত্তি, সেই বিষয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর ব্যক্তি, সমাজ এমনকি দেশের নীতি নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ভালো থাকার ধারণা পরিমাপ করার জন্য গবেষকরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এর মধ্যে একটি হলো ‘স্যাটিসফ্যাকশন উইথ লাইফ স্কেল’।

এই পদ্ধতিতে, অংশগ্রহণকারীদের জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তাদের সন্তুষ্টির মাত্রা জানতে চাওয়া হয়। যেমন, “আমার জীবন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমার আদর্শের কাছাকাছি” অথবা “আমি আমার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট”।

এই প্রশ্নের উত্তরে ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্ক, আর্থিক অবস্থা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

তবে, সুখ পরিমাপের এই পদ্ধতি নিয়ে কিছু সমালোচনাও রয়েছে। যেমন, ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’-এ ব্যবহৃত একটি প্রশ্ন, যেখানে একটি মইয়ের ধারণা ব্যবহার করা হয়।

অংশগ্রহণকারীদের বলা হয়, মইয়ের উপরে তাদের জীবনের সেরা দিক এবং নিচে সবচেয়ে খারাপ দিক কল্পনা করতে। এর মাধ্যমে তাদের জীবনকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে মূল্যায়ন করতে বলা হয়, যা সম্ভবত তাদের উত্তরের উপর প্রভাব ফেলে।

বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সুখের ধারণাও ভিন্ন। পশ্চিমা বিশ্বে সুখের গুরুত্ব বেশি, কিন্তু অন্যান্য সংস্কৃতিতে ভালো থাকার সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত। পোলিশ বিজ্ঞান একাডেমির গবেষক কুবা ক্রাইস এবং তার সহকর্মীরা ৬১টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোতে সুখের আদর্শ বেশি প্রচলিত।

তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ভালো থাকার সংজ্ঞা এবং সুখকে প্রায় সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে, অন্যান্য সংস্কৃতিতে ভালো থাকার জন্য সুখের পাশাপাশি জীবনের অর্থ, সম্পর্ক, এবং সমাজের প্রতি অবদান রাখার মতো বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রাইস মনে করেন, ভালো থাকার ধারণাটিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে হলে, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করা উচিত। তিনি এবং তার দল ‘ইন্টারডিপেন্ডেন্ট হ্যাপিনেস স্কেল’ ব্যবহার করে দেখেছেন, কিছু সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে চীন ও জাপানের মতো সমাজে, সামাজিক সম্পর্ক এবং সম্প্রদায়ের সঙ্গে একাত্মতা ভালো থাকার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ভালো থাকার ধারণাটিকে আরও পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হলে, মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। বিশেষ করে, পশ্চিমা সংস্কৃতির বাইরে অন্যান্য সংস্কৃতিতে ভালো থাকার ধারণাগুলো আরও ভালোভাবে জানতে হবে।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক জোনাস শোয়েনের মতে, ভালো থাকার ধারণা সম্পর্কে আরও গভীর জ্ঞান লাভের জন্য মুক্ত আলোচনা এবং বিভিন্ন ধরনের মানুষের অভিজ্ঞতার প্রতি মনোযোগ দেওয়া দরকার।

তবে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সোনজা লিয়ুবোমিরস্কি মনে করেন, সুখ ভালো থাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

তিনি বলেন, জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া, সামাজিক সম্পর্কে ভালো থাকা এবং ভালো কিছু করার অনুভূতি—এগুলো সবই ‘ইউডাইমোনিয়া’-র অংশ এবং এগুলো সুখের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

সুতরাং, ভালো থাকার ধারণাটি একটি বহুমাত্রিক বিষয়। সুখ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভালো থাকার জন্য প্রয়োজন জীবনের গভীরতা, সামাজিক সম্পর্ক এবং সমাজের প্রতি অবদান।

ভালো থাকার এই বহুমাত্রিক ধারণা আমাদের জীবনকে আরও অর্থবহ করে তোলে।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *