হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে এক বৃদ্ধের সংগ্রাম: হারারের সংস্কৃতি বাঁচানোর গল্প

হারারের এক বৃদ্ধ, যিনি হারানো ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ার হারার শহরের কথা। একসময় এই শহরটি ছিল ইসলামি শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখানকার মানুষেরা আরবি ও আজমি (আরবি প্রভাবিত) হরফে ধর্মীয় গ্রন্থ, আইন বিষয়ক বই এবং প্রার্থনার বই লিখতেন।

কালের পরিক্রমায় সেই শহরের সংস্কৃতিতে নেমে আসে দুর্যোগ। এক সময়ের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। তবে, এই শহরেরই একজন মানুষ, যিনি তাঁর জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন হারানো ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করা।

তাঁর নাম: আব্দুল্লাহ আলী শেরিফ।

পঁচাত্তর বছর বয়সী আব্দুল্লাহ আলী শেরিফ হারারের পুরোনো শহরের বাসিন্দা। তাঁর বাড়িতে গেলে চোখে পড়ে ধুলো জমা পুরোনো ক্যাসেট এবং মেঝেতে ছড়ানো পুরানো খবরের কাগজ। অতীতের স্মৃতি বুকে আগলে রাখা এই মানুষটি হারারের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতি নিবেদিত।

তাঁর চোখেমুখে সেই হারানো দিনের প্রতিচ্ছবি যেন এখনো লেগে আছে।

হারারের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, একসময় এই শহরটি ছিল আডাল সালতানাতের রাজধানী। এখানকার মুসলিম শাসকেরা লোহিত সাগর হয়ে আরব উপদ্বীপের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন।

কিন্তু ১৮৮৭ সালে মেনেলিক দ্বিতীয়ের বাহিনী হারার জয় করে নেয়। এরপর শুরু হয় এখানকার ইসলামিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধ্বংসের প্রক্রিয়া।

আরবি নামফলকগুলো বদলে সেখানে আমহারিক ভাষার ব্যবহার শুরু হয়। হারারের বৃহত্তম মসজিদটিকে গির্জায় রূপান্তরিত করা হয়। ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রগুলো ভেঙে ফেলা হয়।

ধর্মীয় রীতিনীতি এবং শিক্ষার ওপরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

আব্দুল্লাহ আলী শেরিফের বেড়ে ওঠা এই কঠিন পরিস্থিতিতে। তিনি জানান, ছোটবেলায় যদি কেউ তাঁদের সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতেন, তাহলে তাঁদের কারাগারে যেতে হতো।

নব্বইয়ের দশকে ইথিওপিয়ায় জাতিগত ফেডারেলিজম প্রতিষ্ঠিত হয়, যা হারারি জনগণকে তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিকাশের সুযোগ করে দেয়। এরপরই আব্দুল্লাহ আলী শেরিফ তাঁর হারানো ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধারের মিশনে নামেন।

তিনি পুরনো দিনের সঙ্গীতের ক্যাসেট, মুদ্রা এবং হাতে লেখা পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে শুরু করেন। মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে তিনি এইসব দুষ্প্রাপ্য জিনিস সংগ্রহ করেন।

তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে, ১৪ বছর আগে, হারারে প্রতিষ্ঠিত হয় ইথিওপিয়ার প্রথম বেসরকারি জাদুঘর, ‘আব্দুল্লাহ শেরিফ জাদুঘর’।

এই জাদুঘরে আসা মানুষদের তিনি হারারের সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে অবগত করেন। তাঁর সংগ্রহে থাকা হাতে লেখা পান্ডুলিপিগুলো যেন এক একটি জানালা, যা দিয়ে তিনি হারানো এক সংস্কৃতিকে নতুন করে আবিষ্কার করেন।

শুধু পান্ডুলিপি সংগ্রহ করাই নয়, আব্দুল্লাহ আলী শেরিফ এইগুলোর সংরক্ষণেও মনোযোগ দেন। তিনি হারারের প্রাচীন পুস্তক বাঁধানোর ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন।

এই কাজটি করতে গিয়ে তিনি খুঁজে বের করেন সেইসব কারিগরদের, যাঁরা একসময় এই কাজে দক্ষ ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে তিনি এই শিল্পকর্মটি শেখেন। বর্তমানে তিনি এই অঞ্চলের সেরা পুস্তক বাঁধানোর কারিগরদের একজন।

হারারের পান্ডুলিপিগুলো মূলত ভারতীয়, ইয়েমেনি ও মিশরীয় স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণে তৈরি করা হতো। এই পান্ডুলিপিগুলোতে স্থানীয় সৃজনশীলতার ছাপ ছিল।

পরিবারগুলোতে পান্ডুলিপিগুলো পবিত্র হিসেবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সংরক্ষণ করা হতো। হারার অঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতে অন্তত দুটি বা তিনটি পান্ডুলিপি থাকত—কোরআন, হাদিস বা অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ।

আব্দুল্লাহ আলী শেরিফের জাদুঘরে বর্তমানে প্রায় ১,৪০০ ইসলামি পান্ডুলিপি রয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার বছরের পুরনো কোরআনও রয়েছে। এছাড়াও, এখানে ৬০০-র বেশি পুরনো দিনের গানের রেকর্ড, বিভিন্ন সরঞ্জাম, তলোয়ার, মুদ্রা, অলঙ্কার, এবং অস্ত্রশস্ত্রও সংরক্ষিত আছে।

বর্তমানে, আব্দুল্লাহ আলী শেরিফ তাঁর জাদুঘরের মাধ্যমে হারারের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করছেন। তিনি স্থানীয়ভাবে তৈরি সরঞ্জাম ব্যবহার করে পান্ডুলিপিগুলো পুনরুদ্ধার করেন এবং বই বাঁধানোর কাজ করেন।

তিনি নিজে হাতে এইসব পান্ডুলিপি পরিষ্কার করেন, ক্ষতিগ্রস্ত পাতাগুলোর মেরামত করেন এবং সেগুলোকে ডিজিটাইজ করেন।

আব্দুল্লাহ আলী শেরিফ মনে করেন, এই কাজগুলো তাঁর সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। তিনি হারারের তরুণদের বই বাঁধানোর প্রশিক্ষণ দেন, যাতে এই ঐতিহ্য টিকে থাকে।

তাঁর ছাত্র, এলিয়াস বুলে, বর্তমানে জাদুঘরে কাজ করেন এবং দর্শকদের বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য করেন। এলিয়াস বলেন, “আমি খুব খুশি যে আমি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই কাজটি করতে পারছি। প্রতিটি বাঁধানো পান্ডুলিপি আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখবে।”

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *