ভারতের একটি বিশাল আকারের এবং বিরল প্রজাতির পাখি হলো গ্রেটার অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক। স্থানীয়ভাবে হাড়গিলা নামে পরিচিত এই পাখিটি বর্তমানে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
তবে, ভারতের আসাম এবং বিহার রাজ্যের নারীদের একটি দল, ‘হারগিলা আর্মি’র অক্লান্ত পরিশ্রমে এই পাখির জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
আসামের প্রায় ২০ হাজার গ্রামীণ মহিলা, যারা এই হারগিলা আর্মির সদস্য, ২০১৪ সাল থেকে হাড়গিলার সংরক্ষণে নিবেদিতভাবে কাজ করছেন।
একসময় এই পাখিটিকে অপরিষ্কার এবং অশুভ মনে করা হতো। মাছ, ব্যাঙ, সাপ, ইঁদুর এবং অন্যান্য ছোট পাখি শিকার করার কারণে এদের সম্পর্কে মানুষের মনে ভুল ধারণা ছিল। এমনকি আবর্জনা স্তূপে খাদ্য খোঁজার কারণেও এদের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু ‘হারগিলা আর্মি’ ধীরে ধীরে মানুষের ধারণা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে।
এই পরিবর্তনের মূল কারিগর ছিলেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. পূর্ণিমা দেবী বর্মন। পাখির প্রতি গভীর ভালোবাসাই তাকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে।
তিনি জানান, তার ঠাকুরমা তাকে প্রথম গ্রামের ধানক্ষেতে ঝাঁক বেঁধে আসা হাড়গিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন। ড. বর্মন, যিনি সম্প্রতি ২০২৪ সালে হুইটলি গোল্ড অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন, হাড়গিলা সংরক্ষণে তার জীবন উৎসর্গ করেছেন।
তার নেতৃত্ব ও হারগিলা আর্মির সহায়তায়, আসামে এই পাখির সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে ১,৮০০ এর বেশি হয়েছে।
ড. বর্মনের প্রধান কৌশল ছিল স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। একসময় গ্রামবাসীরা তাদের বাড়ির পাশের গাছে বাসা তৈরি করা হাড়গিলাকে অপছন্দ করত।
তারা গাছগুলো কেটে ফেলতে চাইত। ড. বর্মন গ্রামের নারীদের সঙ্গে মিশে তাদের রান্না প্রতিযোগিতায় উৎসাহিত করতেন। শিশুদের কল্যাণে সম্মিলিত প্রার্থনা সভার আয়োজন করতেন।
একই সঙ্গে তিনি তাদের হাড়গিলার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করেন।
নারীদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভর করার জন্য তিনি আসামের ঐতিহ্যবাহী বয়ন শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
স্থানীয় সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে তাঁত ও সুতোর ব্যবস্থা করা হয়। ২০১৭ সালে ‘হাড়গিলা বয়ন কেন্দ্র’ খোলা হয়, যেখানে মহিলারা পাখির মোটিফ দিয়ে কাপড় বুনতে শুরু করেন।
এই কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাক, ব্যাগ, এবং কুশন স্থানীয় বাজার ও অনলাইন দোকানে বিক্রি করা হয়। এর ফলে গ্রামের মহিলাদের মাসিক আয় দ্বিগুণ হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়নে অবদানের জন্য ড. বর্মন ২০২২ সালে ইউএনইপি’র আর্থ চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার লাভ করেন।
আসামের পাশাপাশি, বিহারেও হাড়গিলার সংখ্যা বাড়ছে। পক্ষীবিদ অরবিন্দ মিশ্র ২০০৬ সালে প্রথম এই রাজ্যে হাড়গিলার উপস্থিতি শনাক্ত করেন।
তিনি গঙ্গা নদীর চরে প্রায় ৪২টি বাচ্চা হাড়গিলা দেখতে পান। এরপর তিনি স্থানীয় গ্রামবাসীদের সহায়তায় পাখিগুলোর জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করেন।
স্থানীয় পুরোহিতদের সহায়তায় তিনি গ্রামবাসীদের মধ্যে এই ধারণা দেন যে, হাড়গিলার আগমন শুভ এবং তাদের বিরক্ত করা উচিত নয়।
বর্তমানে, গ্রেটার অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্কের প্রজনন ক্ষেত্রগুলি রক্ষার জন্য কাজ চলছে। পাখির বাসাগুলির আশেপাশে জাল স্থাপন করা হচ্ছে এবং নতুন চারা রোপণ করা হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা পাখির খাদ্যে প্লাস্টিক ও ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন। এটি তাদের জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও বাস্তুতন্ত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
ড. বর্মন ২০৩০ সালের মধ্যে হাড়গিলার সংখ্যা ৫,০০০-এ উন্নীত করতে এবং হারগিলা আর্মির সদস্য সংখ্যা দ্বিগুণ করতে চান।
তার মতে, স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনা এবং তাদের সঙ্গে পাখির সহাবস্থান নিশ্চিত করাই হলো সংরক্ষণের আসল সাফল্য। এই ধরনের কমিউনিটি-ভিত্তিক সংরক্ষণ মডেল বিশ্বের অন্যান্য বিপন্ন পাখির ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা যেতে পারে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।