মৌমাছি বনাম বন্য মৌমাছি: দ্বীপে ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের প্রমাণ!

মৌমাছির জগৎ-এ এক নীরব যুদ্ধ চলছে, যেখানে টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে চ্যালেঞ্জ জানানো হচ্ছে। ইতালির একটি ছোট্ট দ্বীপ, জিয়ান্নুত্রিতে (Giannutri) সম্প্রতি চালানো এক গবেষণায় এর প্রমাণ মিলেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মৌমাছি (Honeybees) বন্য মৌমাছিদের (wild bees) জীবনযাত্রায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।

জিয়ান্নুত্রি দ্বীপটি টাস্কান দ্বীপপুঞ্জ জাতীয় উদ্যানের (Tuscan Archipelago National Park) একটি অংশ। ২০১৮ সাল থেকে এখানে প্রতি বছর বুনো ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌমাছিরা।

তবে, গত কয়েক বছর ধরে, লরেঞ্জো পাস্কুয়ালি নামের এক গবেষক এক ভিন্ন ধরনের পরীক্ষা চালাচ্ছেন। তিনি মধু মৌমাছির চাক (hive) বন্ধ করে দিয়ে বন্য মৌমাছিদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেছেন।

পোল্যান্ডের বাইস্টক বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Bialystok) এই গবেষক এবং তাঁর সহকর্মীরা দ্বীপটিকে গবেষণাগারে পরিণত করেন, যেখানে তাঁরা দেখতে পান, মধু মৌমাছিদের উপস্থিতিতে বন্য মৌমাছির জীবনযাত্রায় কেমন পরিবর্তন আসে।

গবেষণার ফলাফল *কারেন্ট বায়োলজি* (Current Biology) জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

এতে দেখা যায়, মধু মৌমাছি আসার পর বন্য মৌমাছির সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। যখন মধু মৌমাছিদের সাময়িকভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়, তখন ফুলের রেণু (pollen) এবং ফুলের রস (nectar)-এর পরিমাণ বাড়ে।

ফলে বন্য মৌমাছিরা আরও বেশি খাবার পায় এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসে।

এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Florence) কীটতত্ত্ববিদ লিওনার্দো ডাপ্পোর্তো।

তিনি জানান, বন্য মৌমাছিরা খাদ্যের জন্য মধু মৌমাছির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না।

এর ফলস্বরূপ, দ্বীপটিতে *অ্যানথোফোরা ডিসপার* (Anthophora dispar) নামক একটি একাকী মৌমাছি প্রজাতি এবং *বম্বাস টেরেস্ট্রিজ* (Bombus terrestris) নামের ভোমরা মৌমাছির (bumblebee) সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।

গবেষকরা খেয়াল করেন, মধু মৌমাছি সরিয়ে নেওয়ার পর কিছু উদ্ভিদে ফুলের রসের পরিমাণ ৫০ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়, এবং পরাগের পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

এর ফলে বন্য মৌমাছিরা আরও বেশি সময় ধরে ফুলের রস পান করতে সক্ষম হয়।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বন্য মৌমাছিরা মধু মৌমাছির কারণে খাদ্য সংগ্রহের সুযোগ হারাচ্ছে, যার ফলে তাদের প্রজনন এবং টিকে থাকার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।

ডাপ্পোর্তো বলেন, “আমরা শুরুতে ভেবেছিলাম, এর প্রভাব সামান্য হবে। কিন্তু ফলাফল আমাদের ধারণাকেও ছাড়িয়ে গেছে।”

এই গবেষণার ফল প্রকাশের পর, টাস্কান দ্বীপপুঞ্জ জাতীয় উদ্যান কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তারা দ্বীপটিতে মৌমাছি পালন বন্ধ করে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো সংরক্ষিত অঞ্চলে, বিশেষ করে যেখানে বিরল বা বিপন্ন প্রজাতির বন্য মৌমাছি রয়েছে, সেখানে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

এই গবেষণার ফল বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমাদের দেশেও বিভিন্ন ফসলের পরাগায়ণে মৌমাছির ভূমিকা অপরিসীম।

সরিষা ও বিভিন্ন ফলের ভালো ফলনের জন্য মৌমাছির স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। তাই, এই গবেষণা থেকে শিক্ষা নিয়ে, আমাদের দেশেও বন্য মৌমাছিদের সংরক্ষণে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

গবেষকরা বর্তমানে পর্যবেক্ষণ করছেন, মধু মৌমাছি অপসারণের ফলে বন্য মৌমাছিদের আচরণে কোনো পরিবর্তন আসে কিনা।

তাঁরা আগামী কয়েক বছর ধরে এই বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাবেন।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *