হংকংয়ের শীর্ষ ধনী লি কা-শিংয়ের একটি ব্যবসায়িক চুক্তিকে কেন্দ্র করে চীন সরকারের সঙ্গে তার সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি তার মালিকানাধীন কোম্পানি, সি কে হাচিসন হোল্ডিংস, পানামা খালের পোর্ট ব্যবসা একটি কনসোর্টিয়ামের কাছে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই কনসোর্টিয়ামের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ সংস্থা ব্ল্যাকরক ইনকর্পোরেটেড। আর এই চুক্তির কারণেই মূলত ক্ষুব্ধ হয়েছে বেইজিং।
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বেইজিংয়ের হংকং বিষয়ক দপ্তরগুলো লি-এর কোম্পানির এই চুক্তির তীব্র সমালোচনা করেছে। এর ফলে, হংকংয়ের ব্যবসায়ীদের জন্য চীনের প্রতি আনুগত্য এবং পুঁজিবাদী স্বার্থ রক্ষার মধ্যে একটি কঠিন সমীকরণ তৈরি হয়েছে।
লি কা-শিং, যিনি ‘সুপারম্যান’ নামে পরিচিত, বিশ্বের শীর্ষ ৫০ জন ধনীর একজন। ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী, তার মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ লক্ষ কোটি টাকার বেশি)।
২০১৮ সালে তিনি সি কে হাচিসন হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসর নিলেও হংকংয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য হংকংয়ের জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিস্তৃত।
আবাসন থেকে শুরু করে সুপারমার্কেট, টেলিযোগাযোগ এবং ইউটিলিটি—সবখানেই তার ব্যবসার বিস্তার রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেও তার কোম্পানির উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে, যেমন—ব্রিটিশ ড্রাগস্টোর চেইন সুপারড্রাগ এবং ইউরোপীয় মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক অপারেটর থ্রি।
পানামা খালের দুই প্রান্তে অবস্থিত পোর্টগুলো ১৯৯৭ সাল থেকে হাচিসনের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এই গুরুত্বপূর্ণ নৌপথের কার্যক্রমে চীনের হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছিলেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনেও লি কা-শিংয়ের প্রভাব রয়েছে। তিনি শীর্ষস্থানীয় চীনা নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং হংকংয়ের নেতা নির্বাচনের জন্য গঠিত কমিটিতেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, একসময় চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা হংকংয়ের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের সমর্থনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। চীনের অর্থনীতির জন্য হংকংয়ের ব্যবসায়ীদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক এবং সম্পদ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, লি কা-শিং কিছু ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের কারণে সমালোচিতও হয়েছেন। ২০১৫ সালে তিনি যখন চীনের মূল ভূখণ্ডের কিছু সম্পদ বিক্রি করেন, তখন চীনের সরকারি সংবাদ সংস্থা শিনহুয়া’র সঙ্গে যুক্ত একটি থিংক ট্যাঙ্ক তাকে অনৈতিক বলে অভিযুক্ত করে।
২০১৯ সালে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভের সময় লি’র নীরবতাকে কেন্দ্র করে বেইজিংপন্থী কিছু সমর্থক তার সমালোচনা করেন।
সি কে হাচিসন হোল্ডিংস গত ৪ মার্চ ঘোষণা করে যে, তারা হাচিসন পোর্ট হোল্ডিংস এবং হাচিসন পোর্ট গ্রুপ হোল্ডিংসের শেয়ার কনসোর্টিয়ামের কাছে বিক্রি করবে। এই কনসোর্টিয়ামের অন্য অংশীদাররা হলো ব্ল্যাকরকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার পার্টনার্স এবং টার্মিনাল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
এই চুক্তির মাধ্যমে কনসোর্টিয়ামটি ২৩টি দেশের ৪৩টি বন্দরের নিয়ন্ত্রণ পাবে, যার মধ্যে পানামা খালের বালবোয়া ও ক্রিস্টোবাল বন্দরও রয়েছে। এই চুক্তির মূল্য প্রায় ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ লক্ষ ৫৩ হাজার কোটি টাকার বেশি)।
তবে, এই চুক্তিতে হংকং বা চীনের মূল ভূখণ্ডের কোনো বন্দরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সি কে হাচিসন জানায়, এই লেনদেন সম্পূর্ণরূপে বাণিজ্যিক প্রকৃতির।
যদিও ট্রাম্প এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন, বেইজিং এতে অসন্তুষ্ট। চীনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক সংবাদ প্রতিবেদনে এই চুক্তিকে ‘সব চীনার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং কোম্পানিটিকে কোন পক্ষ নেবে, সে বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।
চীনা সামাজিক মাধ্যম উইবো’তে এই চুক্তি নিয়ে করা মন্তব্যগুলোতেও লি কা-শিংয়ের প্রতি সমালোচনাই বেশি দেখা যাচ্ছে।
পানামার সরকারের অনুমোদন পেলে তবেই এই চুক্তি কার্যকর হবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্দরগুলো কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এ ধরনের চুক্তি সব সময়ই সংবেদনশীল। হংকংয়ের ব্যবসা এবং বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক ভবিষ্যতে কেমন হবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ব্যক্তিগত খাতের ব্যবসায়িক নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তবে অনেকেই মনে করেন, ব্যবসার স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও তাদের দলীয় লাইন অনুসরণ করতে হতে পারে।
যদি বেইজিং এই চুক্তি বাতিল করার জন্য লি’র ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তবে ট্রাম্প প্রশাসন হংকং এবং চীনের ব্যবসায়ীদের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস