হাঙ্গেরি এবং রাশিয়ার মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করতে ওয়াশিংটনে গিয়েছেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অর্বান।
শুক্রবার হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে অর্বানের মূল উদ্দেশ্য ছিল, রাশিয়া থেকে তেল কেনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায় করা। খবর সূত্রে জানা যায়, এই বিষয়ে ট্রাম্পের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি।
কোল্ড ওয়ারের সময় হাঙ্গেরিতে রাশিয়ার প্রভাবের তীব্র বিরোধী ছিলেন অর্বান। কিন্তু গত এক দশকে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছেন।
পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক সমালোচকের মতে, তিনি এখন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও তিনি রাশিয়ার পক্ষ অবলম্বন করেছেন। এমনকি, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কট্টর সমর্থক হিসেবেও পরিচিত।
বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চতুর্থ বছর চলছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্রাসেলস এবং ওয়াশিংটন উভয় দিক থেকেই হাঙ্গেরির উপর রাশিয়ার তেল নির্ভরতা কমানোর জন্য চাপ বাড়ছে।
কারণ, এই তেলের মাধ্যমেই রাশিয়া তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থ সংগ্রহ করে থাকে।
যদিও গত মাসে ট্রাম্প প্রশাসন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি কোম্পানি– যেমন, লুকোয়েল এবং রোসনেফটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এর ফলে ভারত, চীন এবং হাঙ্গেরির মতো দেশগুলোও নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে পারে।
কিন্তু হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের কারণে তিনি এই বিষয়ে সুবিধা পেতে পারেন।
গত সপ্তাহে এক সাক্ষাৎকারে অর্বান জানান, তিনি আমেরিকানদের বোঝাতে চেষ্টা করবেন যে, হাঙ্গেরির জন্য রাশিয়ার জ্বালানি কেনা এখনো জরুরি।
ভিক্টর অর্বান যুক্তি দেন, মধ্য ইউরোপের স্থলবেষ্টিত দেশ হাঙ্গেরির কাছে রাশিয়ার তেল ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার তেল সরবরাহ বন্ধ হলে হাঙ্গেরির অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে।
যদিও সমালোচকরা তাঁর এই যুক্তির সঙ্গে একমত নন।
অন্যদিকে, ট্রাম্পের বক্তব্যে অর্বানের প্রতি সমর্থন পাওয়া যায়।
গত অক্টোবরে তিনি অর্বানকে একজন ‘মহান নেতা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার তেল কেনার ক্ষেত্রে হাঙ্গেরি ‘এক প্রকারের সমস্যায়’ পড়েছে।
ট্রাম্পের মতে, হাঙ্গেরির হাতে কেবল একটি পাইপলাইন আছে, যা ইউক্রেন হয়ে রাশিয়ার তেল সরবরাহ করে থাকে।
তবে, হাঙ্গেরির সমালোচকদের মতে, ক্রোয়েশিয়ার আড্রিয়া উপকূল থেকে আসা আরেকটি পাইপলাইন দিয়েও হাঙ্গেরিতে তেল সরবরাহ করা সম্ভব।
তাদের ধারণা, এই পথে রাশিয়া বাদে অন্য কোনো দেশ থেকেও তেল আনা যেতে পারে, যা হাঙ্গেরির জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
মার্কিন থিংক ট্যাঙ্ক আটলান্টিক কাউন্সিলের ফেলো এবং পোল্যান্ডে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল ফ্রাইড অর্বানের এই যুক্তির তীব্র সমালোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, হাঙ্গেরি বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো চেষ্টা করেনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ সদস্য রাষ্ট্র ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে।
কিন্তু হাঙ্গেরি এবং প্রতিবেশী স্লোভাকিয়া এখনো পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল নেওয়া অব্যাহত রেখেছে। এমনকি, তারা তাদের জ্বালানি মিশ্রণে রাশিয়ার তেলের অংশও বাড়িয়েছে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাডসন ইনস্টিটিউটের ইউরোপ ও ইউরেশিয়া বিষয়ক কেন্দ্রের পরিচালক পিটার রাফ বলেন, রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি সরবরাহ নেওয়ার কারণে হাঙ্গেরি অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর চেয়ে সুবিধা ভোগ করেছে।
তবে, ট্রাম্প প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন হাঙ্গেরির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ‘আতঙ্ক’ সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, গত অক্টোবরে ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনার জন্য পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং সেই বৈঠকের স্থান হিসেবে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
যদিও পরে এই বৈঠক বাতিল করা হয়।
বর্তমানে হাঙ্গেরির কর্মকর্তারা এখনো ট্রাম্প-পুতিনের মধ্যে বৈঠকের সম্ভাবনা দেখছেন।
হাঙ্গেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার সিজ্জার্তো সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, শুক্রবারের বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয় হবে ইউক্রেনে শান্তি ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা।
ন্যাটোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও হাঙ্গেরি ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করতে রাজি হয়নি এবং তাদের সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র পরিবহনের অনুমতিও দেয়নি।
এছাড়াও, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু নিষেধাজ্ঞাকেও তারা সমর্থন করতে রাজি হয়নি।
ইউক্রেন এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রতি প্রায়ই বিরূপ মন্তব্য করতে দেখা যায় অর্বানকে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো যারা ইউক্রেনকে সাহায্য করতে চায়, তাদের তিনি যুদ্ধবাজ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
ইউরোপে বন্ধুহীন এই নেতা ট্রাম্পের ওপর ভরসা রাখছেন।
আটলান্টিক কাউন্সিলের ফেলো ড্যানিয়েল ফ্রাইডের মতে, অর্বান ট্রাম্পের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে অনেক চেষ্টা করেছেন এবং শুক্রবারের বৈঠকে তিনি এর ফল পেতে চাইবেন।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস