ইউক্রেন নিয়ে হাঙ্গেরির অবস্থানে ফাটল, ইইউ-এর সঙ্গে সম্পর্ক কোন দিকে?
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর সঙ্গে হাঙ্গেরির সম্পর্ক বর্তমানে এক কঠিন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এর মূল কারণ হলো ইউক্রেন-সংক্রান্ত বিষয়ে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের নেওয়া বিতর্কিত অবস্থান। ইইউ-এর নীতি ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে হাঙ্গেরি একদিকে যেমন রাশিয়ার প্রতি নমনীয়তা দেখাচ্ছে, তেমনই ইউক্রেনের ইইউ সদস্যপদ লাভের পথেও বাধা সৃষ্টি করছে।
এই পরিস্থিতিতে ইইউ-এর পক্ষ থেকে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি হাঙ্গেরিতে ইউক্রেনের ইইউ সদস্যপদ নিয়ে একটি গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। সরকার পক্ষের প্রচারণায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন der লেয়েন এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ম্যানফ্রেড ওয়েবারের ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই প্রচারণার মূল সুর হলো, ইউক্রেনকে ইইউ-এর সদস্যপদ দিলে হাঙ্গেরির অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের মতে, ইউক্রেনকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য করতে গিয়ে হাঙ্গেরিকে তাদের নিজস্ব বাজেট কাটছাঁট করতে হবে।
এছাড়াও, তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে ইউক্রেন থেকে আসা সস্তা শ্রমিকের কারণে হাঙ্গেরির নাগরিকদের চাকরি হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি, তিনি ইউক্রেনীয়দের পর্যাপ্ত টিকাকরণ না থাকার কারণে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হাঙ্গেরির ক্ষমতাসীন দল ফিদেজ (Fidesz) বুঝতে পেরেছে যে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতি হাঙ্গেরির জনগণের মধ্যে এক ধরনের বিরূপ মনোভাব রয়েছে। তাই, তারা এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে গড়িমসি করছে।
হাঙ্গেরি ইতোমধ্যেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইইউ-এর নেওয়া বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞাকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে এবং ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার জন্য অন্যান্য ইইউ দেশগুলোকে ৬ বিলিয়ন ইউরো দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এছাড়াও, ইউক্রেনকে সমর্থন জানিয়ে ইইউ-এর দুটি ঘোষণাপত্রেও হাঙ্গেরি স্বাক্ষর করতে রাজি হয়নি।
ইইউ-এর অনেক সদস্য রাষ্ট্র মনে করছে, হাঙ্গেরির এই ধরনের কার্যকলাপ তাদের জোটের জন্য উদ্বেগের কারণ। তাই, তারা এখন ইইউ চুক্তির ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রয়োগের কথা ভাবছে।
এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো সদস্য রাষ্ট্রের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যেতে পারে। তবে, এটি কার্যকর করতে হলে ইইউ-এর বাকি ২৬টি সদস্য রাষ্ট্রের ঐকমত্য প্রয়োজন। অতীতে পোল্যান্ডের রক্ষণশীল সরকার এই ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছিল।
বর্তমানে, স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোর হাতে সেই ক্ষমতা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা এবং সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে সীমিত করা। এই বিষয়গুলো নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ইতোমধ্যেই আলোচনা শুরু করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, যদি হাঙ্গেরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়াতে ভেটো দেয়, তাহলে ইইউ-এর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। কারণ, রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় ২১০ বিলিয়ন ইউরোর সম্পদ ইইউ-তে জব্দ করা হয়েছে এবং এই অর্থ ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং পুনর্গঠনের কাজে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে, হাঙ্গেরির পক্ষ থেকে অতীতে বিভিন্ন সময় ভেটো দেওয়ার হুমকি দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটেছে। কূটনীতিকরা মনে করছেন, এবারও হয়তো তেমন কিছু ঘটবে।
অন্যদিকে, হাঙ্গেরিতে বিরোধী দলের নেতা পেটার ম্যাগয়ারের উত্থান বর্তমান সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ম্যাগয়ারের দল টিজা (Tisza) জনপ্রিয়তায় ফিদেজকে ছাড়িয়ে গেছে।
সরকার এই মুহূর্তে ম্যাগয়ারকে হেয় করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। উদাহরণস্বরূপ, সরকার ম্যাগয়ারকে “ইউক্রেনপন্থী” হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে এবং অভিযোগ করছে যে তিনি ব্রাসেলসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাঙ্গেরীয়দের জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দিচ্ছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আগামী নির্বাচনে জয়লাভের জন্য সরকার যেকোনো ধরনের কৌশল অবলম্বন করতে পারে। এমনকি, তারা নির্বাচনের ফল নিজেদের পক্ষে আনতে কারচুপির আশ্রয় নিতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক কূটনীতিক মনে করেন, হাঙ্গেরির “সমস্যা” সমাধানের সেরা উপায় হলো নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করা। তবে, অনেকে মনে করেন, এটি সঠিক পদক্ষেপ নয়।
তাঁদের মতে, ইইউ-এর উচিত হাঙ্গেরির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করা এবং দেশটির মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো নিয়ে সোচ্চার হওয়া।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান