আইসক্রিম ও খাবারে থাকা ক্ষতিকর উপাদান, অন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উদ্বেগের?

খাবারে ব্যবহৃত ‘ইমালসিফায়ার’ স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?

আধুনিক খাদ্য প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর দিক হলো আইসক্রিম, যা সহজে গলে যায় না। গরম আলোতেও এর আকার বজায় থাকে। এর পেছনের মূল উপাদান হলো ‘পলিশরবেট ৮০’।

এই উপাদানটি এক ধরনের ‘ইমালসিফায়ার’ বা স্থিতিকারক রাসায়নিক পদার্থ, যা হাজারো খাদ্যপণ্যের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও কার্বক্সিমিথাইল সেলুলোজ, ক্যারেজেনান এবং মাল্টোডেক্সট্রিনের মতো উপাদানগুলোও খাদ্য প্রস্তুতিতে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।

সম্প্রতি, এই ধরনের উপাদানগুলো নিয়ে নতুন কিছু গবেষণা হচ্ছে। যেখানে বলা হচ্ছে, এইসব ‘ইমালসিফায়ার’-এর কারণে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। গবেষণা বলছে, এইসব উপাদান অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার মিশ্রণে পরিবর্তন আনতে পারে, যা ‘মাইক্রোবায়োম’ বা অন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়।

এর ফলে পরিপাকতন্ত্রের আস্তরণে ক্ষতি হতে পারে এবং প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে। যা শরীরের অন্যান্য অংশেও সমস্যা তৈরি করতে পারে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানাচ্ছে, অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারে ‘ইমালসিফায়ার’ এবং স্থিতিকারক উপাদানগুলো খুব সাধারণ বিষয়। যদিও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এখনও অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে, তবে খাদ্য বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় এইসব উপাদান নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ইমালসিফায়ার’-এর কারণে শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে এবং অন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত হতে পারে। যার ফলস্বরূপ, ক্রনিক রোগ, যেমন – ‘ক্রোনস ডিজিজ’ ও ‘আলসারেটিভ কোলাইটিস’, মেটাবলিক ডিসঅর্ডার এবং ক্যান্সারের মতো রোগ হতে পারে।

এসব রাসায়নিক উপাদান অন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকারিতার জন্য ক্ষতিকর। তাই এগুলো ব্যবহার করা বন্ধ করা উচিত।”

ফ্রান্সের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক বেনোয়া শ্যাসিং

এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আরও বড় পরিসরে গবেষণা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যায় আক্রান্ত লুইস র‍্যান্ডস নামের একজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতা হলো, খাদ্য তালিকা থেকে ‘ইমালসিফায়ার’ বাদ দেওয়ার ফলে তার শারীরিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। তিনি জানান, আগে তার শরীরে যে লক্ষণগুলো দেখা দিত, খাদ্য পরিবর্তনের ফলে তা কমে এসেছে।

অন্যদিকে, ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট এবং গবেষক অশ্বিন অনন্তakrishnan বলেছেন, “চিকিৎসাগতভাবে অনেক রোগী এই পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের উপসর্গের উন্নতি অনুভব করেছেন।”

তবে, এই গবেষণাগুলোর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন – বেশিরভাগ গবেষণা ইঁদুরের ওপর করা হয়েছে বা মানুষের অন্ত্রের প্রক্রিয়াকে পরীক্ষাগারে অনুকরণ করা হয়েছে। সব ‘ইমালসিফায়ার’-এর খারাপ প্রভাব নেই এবং কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এর প্রভাব বেশি হতে পারে।

এমনকি, কিছু গবেষকও বলছেন, মানুষের শরীরে এই উপাদানগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব এখনো প্রমাণ করা যায়নি এবং নিয়ন্ত্রকদের এখনই এগুলো নিষিদ্ধ করার কথা বলা সঠিক হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ)-এর জন্য এই গবেষণাগুলো একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। কারণ, যখন খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় ‘ইমালসিফায়ার’-এর ব্যবহার শুরু হয়, তখন তারা অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের ওপর সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি।

যদিও বর্তমানে এফডিএ-এর প্রধান মার্টিন মাকারি, এই মাইক্রোবায়োম নিয়ে কাজ করার কথা বলেছেন।

বর্তমানে বাজারে উপলব্ধ অনেক খাবারে ‘ইমালসিফায়ার’ ব্যবহার করা হয়, যা এড়িয়ে চলা বেশ কঠিন। যেমন – একটি অনলাইন ডেটাবেজ অনুসারে, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে পলিশরবেট ৮০ যুক্ত ২,৩১১টি পণ্য পাওয়া গেছে।

এছাড়া ক্যারেজেনান ৮,১০০টি, মাল্টোডেক্সট্রিন ১২,৭৬৯টি এবং জ্যানথান গাম ১৭,১৫৩টি পণ্যের লেবেলে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

কিছু ‘ইমালসিফায়ার’-এর একাধিক নাম থাকায় তাদের চিহ্নিত করা কঠিন। এছাড়াও, কিছু রাসায়নিক নাম খাদ্য লেবেলে দেখা গেলেও, এফডিএ-এর ‘খাদ্যে যোগ করা উপাদান’-এর তালিকায় সেগুলোর উল্লেখ নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নামকরণ পদ্ধতি খাদ্য উপাদানগুলো ট্র্যাক করা, মানুষের গ্রহণ করা উপাদানের পরিমাণ পরিমাপ করা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত রাসায়নিকগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে সমস্যা তৈরি করে।

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের বাজারে উপলব্ধ বিভিন্ন ফাস্ট ফুড, রেডি-টু-ইট ফুড, বেকারি পণ্য এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাবারে এই ধরনের ‘ইমালসিফায়ার’-এর ব্যবহার দেখা যায়।

এই বিষয়ে, খাদ্য প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘কনজিউমার ব্র্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন’ তাদের পণ্যের নিরাপত্তা এবং গুণগত মান রক্ষার কথা জানিয়েছে। তবে, এফডিএ কীভাবে অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের ওপর এই রাসায়নিকগুলোর প্রভাব বিশ্লেষণ করেছে, সে বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এফডিএ প্রধান রবার্ট ক্যালিফ বলেছেন, বিজ্ঞানীরা সবেমাত্র মাইক্রোবায়োম সম্পর্কে জানতে শুরু করেছেন। তার মতে, এই উপাদানগুলো যখন অনুমোদন করা হয়েছিল, তখন সেগুলো বিদ্যমান মানদণ্ড পূরণ করত। তবে, এখন সেই মান উন্নত করা দরকার।

এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত এবং নির্ভরযোগ্য গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *