আতঙ্কের ছবি! ভারতে সিংহের সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল

ভারতে সিংহের সংখ্যা বৃদ্ধি: উদযাপন নাকি এক মারাত্মক সমস্যা?

গুজরাটের জঙ্গলে এশীয় সিংহের সংখ্যা বাড়ছে, যা একদিকে যেমন আনন্দের খবর, তেমনই উদ্বেগেরও কারণ। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে এটি একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য, কিন্তু এর ফলস্বরূপ মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে সংঘাত বাড়ছে, যা জীবনহানির কারণ হচ্ছে। সম্প্রতি, পাঁচ বছর বয়সী পুলসিং আজনেরার মর্মান্তিক মৃত্যু এই সমস্যার গভীরতা আরও একবার সামনে এনেছে।

ছেলেটি যখন তার ভাইদের সঙ্গে বাড়ির কাছে একটি মাঠে খেলছিল, তখন একটি সিংহ “কোথা থেকে যেন” এসে তাকে আক্রমণ করে। ছেলের বাবা হীরা আজনেরা সিএনএনকে জানান, “সিংহটি আমার ছেলেকে ধরে জঙ্গলে নিয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা তাকে বাঁচাতে পাথর ও লাঠি ছুঁড়েছিল, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।” পরে ছেলের দেহ উদ্ধার করা হয়।

২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত এক বছরে ভারতে সিংহের আক্রমণে সাতজন নিহত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে মৃতের সংখ্যা ২০ জনের বেশি। গুজরাট রাজ্যের সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একই সময়ে গবাদি পশুর উপর সিংহের আক্রমণের ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

এশীয় সিংহ, যাদের কেশর কালো এবং পেটের চামড়ায় বিশেষ ভাঁজ দেখা যায়, তাদের আফ্রিকান আত্মীয়দের তুলনায় আকারে সামান্য ছোট। একসময় মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দেখা মিলত, কিন্তু বর্তমানে গুজরাটেই বন্য এশীয় সিংহের শেষ আবাসস্থল।

একসময় ভারতে এই সিংহ প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এক শতাব্দী আগে গুজরাটে সিংহ শিকার নিষিদ্ধ করার পর থেকে তাদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংরক্ষণ প্রচেষ্টার ফলে, রাজ্যের সিংহ জনসংখ্যা ৩০% বৃদ্ধি পেয়ে ৮৯১-এ দাঁড়িয়েছে।

সংরক্ষণবিদদের মতে, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সিংহের এক বিশেষ সম্পর্ক এই সাফল্যের মূল কারণ। স্থানীয়রা সিংহের উপস্থিতির কারণে পর্যটন থেকে লাভবান হন এবং সিংহগুলোও তাদের খাদ্য হিসেবে এখানকার পশুদের ব্যবহার করে। কিন্তু সিংহের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সহাবস্থানের নীতি এখন প্রশ্নের মুখে।

বন্যপ্রাণী জীববিজ্ঞানী রবি চেল্লাম বলেন, “সিংহকে যখন মানুষের বসতিপূর্ণ এলাকায় দেখা যায়, তখন তাদের দ্বারা আক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।” তিনি আরও জানান, “সিংহ এখন আবাসিক এলাকার পার্কিং লট, এমনকি মানুষের বাড়ির ছাদেও দেখা যাচ্ছে।

চেল্লাম এবং অন্যান্য সংরক্ষণবিদরা দীর্ঘদিন ধরে গুজরাট সরকারকে কিছু সিংহকে রাজ্যের বাইরে সরিয়ে অন্য একটি নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের জন্য চাপ দিচ্ছেন।

তবে, গুজরাটের সরকার সিংহ স্থানান্তরের বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং, তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, যা সংঘাতের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যদিও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে সিংহ স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছিল।

গির জাতীয় উদ্যান, যা প্রায় লস অ্যাঞ্জেলের সমান, ১৯৬০-এর দশকে এশীয় সিংহ সহ বিভিন্ন বিপন্ন প্রজাতিকে রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে গুজরাটের সিংহগুলির বেশিরভাগই উদ্যানের বাইরে বসবাস করে, যা গ্রাম ও শহরগুলোতে মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করেছে।

সংরক্ষণবিদ জেহান ভুজওয়ালা সিএনএনকে বলেন, “সংরক্ষণ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি করা। সেই হিসেবে, এটি একটি সাফল্যের গল্প।” তিনি আরও বলেন, “কিন্তু যখন পশুর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়, তখন তারা সংরক্ষিত এলাকার বাইরে জায়গা খোঁজা শুরু করে এবং স্থানীয় মানুষের সঙ্গে তাদের সংঘাত বাধে।

স্থানীয় মানুষেরা পর্যটন থেকে আয়ের জন্য সিংহের উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, সিংহগুলো স্থানীয় রাখালদের পরিত্যক্ত পশু শিকার করে, যা তাদের খাদ্যের চাহিদা মেটায়।

যাদবেন্দ্রদেব বিক্রমসিংহ ঝালা, যিনি একসময় ভারতীয় বন্যপ্রাণী ইনস্টিটিউটের ডিন ছিলেন, এক গবেষণাপত্রে লিখেছেন, সিংহ শূকর এবং নীলগাই শিকার করে, যা স্থানীয় কৃষকদের জন্য ক্ষতিকর প্রাণী।

স্থানীয় মানুষেরা সিংহের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখেছে, কারণ তাদের অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো ঝুঁকির চেয়ে বেশি। ঝালা আরও বলেন, “মানুষ এবং একটি বৃহৎ মাংসাশী প্রাণীর মধ্যে এমন সহাবস্থান পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না।

তবে, স্থানীয় মানুষের মধ্যে একটা অসন্তোষ বাড়ছে, কারণ সিংহের আক্রমণে গবাদি পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সংরক্ষণবিদরা সতর্ক করেছেন, সিংহের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আরও পদক্ষেপ না নিলে মানুষ ও সিংহের মধ্যেকার সম্পর্ক শীঘ্রই বদলে যেতে পারে।

সিংহ স্থানান্তরের পরিকল্পনা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। সংরক্ষণবিদ চেল্লাম এবং আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের কুনো বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে কিছু সিংহকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

১৯৯৪ সালে পরিবেশ আইন কেন্দ্র এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার ইন্ডিয়া যৌথভাবে গুজরাট সরকারকে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়। ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পরিবেশবাদী দলগুলোর পক্ষে রায় দেয় এবং পরিবেশ মন্ত্রকে “গির বন থেকে কুনোতে এশীয় সিংহ স্থানান্তরের জন্য জরুরি পদক্ষেপ” নিতে নির্দেশ দেয়।

চেল্লাম জানান, কমিটির শেষ বৈঠকটি ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তার মতে, সরকার নিয়মিত বৈঠক না করে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে উপেক্ষা করছে।

এই পরিস্থিতিতে কুনো বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়া থেকে আনা চিতা বাঘের আগমন সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে।

ভারতে চিতা ফিরিয়ে আনার ঐতিহাসিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রথম চিতা বাঘগুলো এখানে আসে। চিতা বাঘগুলি কুনোতে বসবাস করছে, যা “সাফল্যের ইঙ্গিত” দেয়।

এদিকে, গুজরাট সরকার কুনোতে সিংহ স্থানান্তরের বিকল্প হিসেবে রাজ্যের বারদা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে কিছু সিংহ সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা সিংহ সুরক্ষার জন্য তহবিলও বৃদ্ধি করেছে।

তবে, চেল্লামের মতে, বারদা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি আকারে ছোট এবং সেখানে পর্যাপ্ত শিকারের অভাব রয়েছে, যা সিংহের জন্য উপযুক্ত নয়। এছাড়াও, গির ন্যাশনাল পার্কের খুব কাছাকাছি হওয়ায় এখানে কোনো রোগ দেখা দিলে তা গুজরাটের সমস্ত এশীয় সিংহকে বিলুপ্ত করে দিতে পারে।

আজনেরার বাবা একসময় বিশ্বাস করতেন মানুষ সিংহের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করতে পারে। তিনি সাত বছর আগে আমরেলি জেলায় একজন কৃষক হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন, যেখানে প্রায়ই সিংহের দেখা পাওয়া যায়। তার বাড়িটি জঙ্গল থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে ছিল। তিনি ভাবতেও পারেননি যে সিংহ মানুষ আক্রমণ করবে।

কিন্তু এখন তিনি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা ওখানে থাকতে পারতাম না। আমরা এলাকা ছেড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরের অন্য একটি গ্রামে চলে গেছি, ভয়ে।”

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *